শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি নেপথ্যে তিন কোটি টাকার হাট ইজারা (ভিডিও)

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),নরসিংদীর শিবপুর প্রতিনিধি, রোববার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : তখনও চারদিকে ভোরের নিশ্চলতা। বাসার অনেকেই অঘোর ঘুমে। ৬টার দিকে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশীদ খানের বাসায় ঢোকে তিন যুবক। দু’জনই তাঁর চেনা। সাতসকালে খুলে দেন দরজা। তারা সময় নেয় কয়েক সেকেন্ড। পেছন থেকে হারুনকে লক্ষ্য করে দুই রাউন্ড গুলি। আর তাতেই বাসার ড্রইংরুমে মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। গুলির আওয়াজে অপ্রস্তুত ঘরের সবাই। স্বজন ও আশপাশের লোকজন আসার আগেই ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে তিন দুর্বৃত্ত। এর পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় বর্ষীয়ান এই আওয়ামী লীগ নেতাকে শিবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন হওয়ায় তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রয়েছেন হারুনুর রশীদ।

Advertisement

কেন, কারা, কী কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সভাপতিকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে- এর রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেছে সমকাল। তথ্য অনুসন্ধান বলছে, স্থানীয় হাটের ইজারা নিয়ে বিবাদে গতকাল শনিবার এ ঘটনা ঘটে। দেশের অন্যতম বড় পাইকারি হাট শিবপুরের পুটিয়া। নানা ধরনের সবজি ছাড়াও এই হাটে বড় পরিসরে গরু-ছাগল কেনাবেচা হয়। এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ৩ কোটি ২৫ লাখ ১ হাজার টাকায় পুটিয়ার হাটের ইজারা পান খোরশেদ হাজি। তবে গত বছর এই হাটের ইজারা যৌথভাবে পেয়েছিলেন খোরশেদ হাজি ও আরিফ সরকার। এবার ইজারা না পেয়ে হারুনুর রশীদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল আরিফ সরকার। ছক করেই হারুনকে হত্যা করতে গতকাল ভোরে ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহসিন মিয়াসহ তিনজনকে নিয়ে মোটরসাইকেলে আওয়ামী লীগ নেতার বাসার সামনে যায় আরিফ। এর পর বাসায় ঢুকে গুলি করে সেখান থেকে পালায়।

১৯৮৬ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনের ভাই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রবিউল আওয়াল কিরন খানকেও সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। দীর্ঘ ৩৭ বছর পরও সেই হত্যা মামলার কোনো কিনারা হয়নি।

Advertisement

আওয়ামী লীগ নেতা হারুনুর রশীদের ভাতিজা রাব্বি খান বলেন, চিকিৎসকরা চাচাকে ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। অস্ত্রোপচার করে দুটি গুলি বের করা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের আগে চাচার জ্ঞান ছিল। বাসায় যে তিনজন ঢুকেছে, তাদের মধ্যে দু’জনকে তিনি চিনেছেন। স্বজন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দু’জনের নামও বলেছেন। তারা হলো- আরিফ সরকার ও মহসিন মিয়া।

জেলা পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, প্রযুক্তিগত তদন্ত ও হারুনের বক্তব্যের সূত্র ধরে তাঁরাও চমকপ্রদ কিছু তথ্য পেয়েছেন। শনিবার বাসার সামনে গিয়ে হারুনকে ফোন করে আরিফ দরজা খুলতে বলে। আরিফ ওই সময় বলে, হারুনের তত্ত্বাবধানে এলাকায় নির্মাণাধীন একটি মসজিদে মোটা অঙ্কের টাকা দান করবে আরিফ। কয়েক দিন আগে ফোন করে দান করার বিষয়টি এই আওয়ামী লীগ নেতাকে জানায় সে। গতকাল দরজায় গিয়ে আরিফ ফোনে মসজিদের নির্মাণ খরচের টাকা নিয়ে এসেছে বলে জানায়। এর পর দরজা খোলেন হারুন। দরজা খোলার পর পূর্বপরিচিত আরিফ, মহসিন মিয়াসহ তিনজনকে দেখে ড্রইংরুমে বসতে বলেন। ড্রইংরুম থেকে ভেতরের রুমের যাওয়ার সময় পেছন দিক থেকে গুলি করে আরিফ।

অন্য একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, শিবপুরের কামারগাঁও এলাকার বাসিন্দা হাবিজ উদ্দিন সরকারের ছেলে আরিফের বিরুদ্ধে আগের একটি হত্যা মামলা ছিল। ২০২১ সালে একবার অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে কয়েক মাস ছিল। হাট ইজারা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও বাসস্ট্যান্ড, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার। অভিযোগ আছে, এসব অপকর্মে তাকে সহায়তা করে স্থানীয় এমপি জহিরুল হক ভূঞা মোহনের ভাই জুনায়েদুল হক জুনু। জুনু নরসিংদী জেলা যুবলীগের সহসভাপতি।

Advertisement

পুটিয়া হাটের বর্তমান ইজারাদার খোরশেদ হাজি বলেন, আরিফ ও আমার গ্রুপ মিলে গত বছর হাটের ইজারা নিয়েছিলাম। এবারও যাতে দু’পক্ষ মিলে ইজারা পাই, সেই চেষ্টা উপজেলা চেয়ারম্যান করেছিলেন। আরিফ কারও কথা শোনেনি। এর পর একাই আমি এ বছর হাট ইজারা পেয়েছি। ৩০ বছর এই হাট চালাই। তিনবার ওরা চুরি করে ইজারা নিয়েছিল। আরিফ এলাকায় দুষ্ট লোক হিসেবে পরিচিত। এমপির ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে চলে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের লোক হয়ে যায়। তবে আমি ব্যবসায়ী। আমার কোনো দল নেই।

মূলত পুটিয়া হাটসহ এলাকার আর্থিক নেটওয়ার্কের আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দীর্ঘদিনের। ইটাখোলা, শিবপুর ও সাদারচর বাজার ছাড়াও স্থানীয় বেশ কয়েকটি অটোরিকশা এবং বাসস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদার ভাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এক পক্ষে রয়েছেন হারুনুর রশীদের লোকজন। আরেক পক্ষে আরিফ সরকার ও তার দলবল।

নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, এ ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে প্রকৃত রহস্য কী, কারা ইন্ধনদাতা- সবকিছু বেরিয়ে আসবে। নম্বরহীন একটি মোটরসাইকেলে দুর্বৃত্তরা হারুনুর রশীদের বাসায় গিয়েছিল। জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।

শিবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিনিয়া জিনাত বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও হাট ইজারা দিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে খোরশেদ হাজি এ বছর ইজারা পান।

শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম ভূঁইয়া রাখিল বলেন, ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে হারুনুর রশীদ খানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সঙ্গে আরিফুলের কোনো সম্পর্ক নেই। সে আমাদের সংগঠনের কেউ নয়।

নরসিংদী প্রতিনিধি ও শিবপুর সংবাদদাতা জানান, হারুনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর এলাকায় চাউর হলে শত শত কর্মী-সমর্থক প্রথমে শিবপুরের রাস্তায় বিক্ষোভ করেন। পরে তাঁরা সকাল ৮টা দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ইটাখোলায় অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। এই বিক্ষোভ দুপুর ২টা পর্যন্ত চলতে থাকে। আশপাশের হাজারো মানুষ এতে অংশ নিয়ে টায়ার ও কাঠ পুড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করে প্রতিবাদ জানান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেন শিবপুরের ইউএনও, এসিল্যান্ড এবং ওসি। তবে সড়ক অবরোধে অনড় থাকেন বিক্ষোভকারীরা। এর পর নরসিংদী জেলা প্রশাসক আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান, পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম উপস্থিত হয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিলে অবরোধকারীরা রাস্তা ছাড়েন।

নরসিংদী-৩ শিবপুর আসনের সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঞা মোহন জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুহসীন নাজির বলেন, আমরা হত্যার রাজনীতি চাই না। অপরাধীদের শাস্তি চাই।

নরসিংদী জেলা প্রশাসক আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান জানান, ঘটনা জানার পর থেকে আমি ও পুলিশ সুপার সার্বক্ষণিক তদারকি করছি। ইটাখোলায় জনতা টায়ারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। খবর পেয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করি।

(আ’লীগ নেতা হারুনুর রশীদ (বামে) অভিযুক্ত আরিফ সরকার (মাঝে) ও মহসিন মিয়া)