মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিলের চূড়ান্ত রায়েও ফাঁসি বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আপিল বিভাগের ষষ্ঠ এবং বাংলাদেশের সাবেক কোন মন্ত্রী পরিষদের তৃতীয় কোন মন্ত্রী দণ্ড পেলেন। এর আগে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
রায় ঘোষণার সময় নিজামীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান, মো. শিশির মনির ও নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমিনসহ জামায়াতে ইসলামীর অর্ধশতাধিক আইনজীবী। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মামতাজ উদ্দিন ফকির ও মুরাদ রেজা।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার প্রধানসহ অন্যান্যরা। এছাড়াও দেশি- বিদেশি মডিয়ার শতাধিক সংবাদ কর্মী নিজামীর রায়ের খবর সংগ্রহ করার জন্য আদালতের এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।
নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার জন্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বুধবারের কার্যতালিকার এক নম্বরে ছিল। এর আগে গত ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৬ জানুয়ারি দিন ধার্য করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
নিজামীর আপিল আবেদনের ওপর ২০১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে চলে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত। পরে ৩০ নভেম্বর নিজামীর আপিলের যুক্তিতর্ক শুরু করে ২ ডিসেম্বর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক পেশ শেষ করে। ট্রাইব্যুনালে নিজামীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত আটটি অভিযোগে সাক্ষ্য-প্রমাণ বিষয়ে তিন কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আসামিপক্ষ। এর বিপরীতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে জাতির মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং হত্যা-গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) মোট চারটি অপরাধের দায়ে নিজামীর ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন আনীত মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
এর মধ্যে চারটি (২ নম্বর অভিযোগ), (৪ নম্বর অভিযোগ), (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর অভিযোগে) নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অন্য চার অভিযোগে (১ নম্বর অভিযোগ), (৩ নম্বর অভিযোগ), (৭ নম্বর অভিযোগ) এবং রুমী, বদি, জালালসহ সাত গেরিলা যোদ্ধা হত্যার প্ররোচনার (৮ নম্বর অভিযোগে) তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ৫ ও ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে খালাস দেয় ট্রাইব্যুনাল।
নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে ২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর আপিল করেন তিনি। ১২১ পৃষ্ঠায় মূল আপিল আবেদনের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে। মূল আপিলে ১৬৮ টি গ্রাউন্ড পেশ করে দণ্ড থেকে খালাস চায়।
রাষ্ট্রপক্ষ আপিল না করার যুক্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ট্রাইব্যুনালে দেয়া দণ্ডের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে তা বহাল রাখতে আর্জি পেশ করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আসা এটি ষষ্ঠ মামলা। এর আগে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আনা আরো ৫টি মামলা আপিলে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে চারটি রিভিউ নিষ্পত্তি করে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
এদিকে আপিল বিভাগে এর আগে পাঁচটি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশ হলেও এখনও রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি।
এছাড়া শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যুবরণ করায় আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।