ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি, মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : ভ্যালেন্টাইন্স ডে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসার দিবস। প্রিয়জনকে ভালোবাসার কথা জানাতে এই দিনটির কোন বিকল্প হয় না, এমনটা মনে করেন অনেকেই। তবে, ভালবাসার আলাদা কোনও দিন হয় না, সব দিনই ভালবাসার- এমনটাই মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ।
Advertisement
আবার নতুন নতুন ভালোবাসার আটকে পড়া যুগলের কাছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র আবেদনই যেন আলাদা। দিনটির জন্য তাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় সপ্তাহখানেক আগেই। সেই সুযোগটি নিতে ছাড়ে না কর্পোরেট দুনিয়াও। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ছড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার লাল রং।
প্রথম দিন গোলাপ দিয়ে, পরের দিন প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে, তৃতীয় দিন চকোলেট আর চতুর্থ দিন টেডি হাতে, পঞ্চম দিন পাশে থাকার অঙ্গীকার করে, ষষ্ঠ দিন একে অপরকে জড়িয়ে, শেষ দিন চুম্বন দিয়ে অনেক অপেক্ষার ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ উদযাপনের শিহরণই অন্যরকম।
এই দিনটিতে লাল রঙের পোশাক, লাল গোলাপ, লাল বেলুন হাতে নগরের অলিগলিতে ভিড় জমতে থাকে যুগলদের। দিন জুড়ে চলে দেদার ঘোরাফেরা। আর খাওয়া-দাওয়া। যুগলের কাছে তাই দিনটি যেন বছরের সেরা দিন। একে অপরের কাছে বিলিয়ে দেয়া দিন।
কিন্তু কয়েক দশক আগেও কি এই ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবস উদযাপনের কোন রীতি এই জনপদে ছিলো, এমন প্রশ্নের জবাব একটাই, না ছিলো না। এটা পুরোপুরি পশ্চিমা কর্পোরেট কালচার। উপমহাদেশে যার পরাগায়ন হয়েছে সময়ের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসাবে।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবসে এই লালের এতো ছড়াছড়ি, এর পেছনেও কিন্তু রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে পোপ গেলাসিয়াস, ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এর পেছনেও রয়েছে করুণ ইতিহাস।
Advertisement
প্রাচীন রোমের বাসিন্দা, খ্রিস্টধর্মের পুরোহিত ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেই উদযাপিত হয়েছিলো এই দিনটি। সেই দেশে নিষিদ্ধ খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য রোমের তৎকালীন সম্রাট রাজা দ্বিতীয় ক্লডিয়াস সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে বন্দি করার আদেশ দেন।
সেখানে আটক থাকার সময় দৃষ্টিহীন এক নারীর চিকিৎসা করে চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেন তিনি। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার জয়গান। ভ্যালেন্টাইনের এই জনপ্রিয়তায় রাজা ক্লডিয়াস ক্রোধে ফেটে পড়েন এবং তাকে নিশ্চিহ্ন করতে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
আরেকটি ইতিহাস বলছে, রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস বিশ্বাস করতেন যে বিয়ে করলে পুরুষের শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। তিনি আদেশ দেন যে তার সৈন্য বা অফিসার, কেউই বিয়ে করতে পারবে না। এছাড়াও সেদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারও নিষিদ্ধ করেন তিনি।
ক্লডিয়াস বিশ্বাস করতেন, অবিবাহিত সৈন্যরা বিবাহিতদের চেয়ে বেশি দক্ষ, তাই তাদের বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি একটি আইন তৈরি করেন যাতে বলা ছিল, সেনাবাহিনীতে চাকরি করা যুবকেরা বিয়ে করতে পারবে না।
Advertisement
ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন যখন এই আইন সম্পর্কে জানতে পারেন তখন বুঝতে পেরেছিলেন এই আইনটি অন্যায়। তাই যে সব সৈন্যরা বিয়ে করতে চাইতেন তাদের জন্য গোপনে বিবাহের কাজ চালিয়ে যান তিনি। পাশাপাশি তিনি অন্যান্যদের মধ্যেও ভালোবাসার বাণী ছড়াতে থাকেন।
খুব তাড়াতাড়িই ক্লডিয়াস ভ্যালেন্টাইনের এই কাজ সম্পর্কে জানতে পারে তাকে কারাবন্দী করে মৃত্যুদণ্ড দেন। যিনি প্রেমের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, সেই ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্বীকার করে সেখানকার মানুষেরা তাকে একটা দিন উৎসর্গ করার কথা ভাবে।
এরপর থেকেই শুরু হয় ভ্যালেন্টাইন্স ডে। অবশ্য আরও একটি গল্প কথিত আছে। যেখানে বলা হয়, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ধর্ম প্রচারের মামলায় অভিযুক্ত করে কারাবাসে পাঠানো হয়। সেখানে থাকার সময় তার চিকিৎসার জাদুতে একজন কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ে দৃষ্টি ফিরে পান।
এরপরেই সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে মেয়েটির পরিবারসহ অনেকেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং মেয়েটির সঙ্গে ভ্যালেন্টাইনের একটি সম্পর্ক তৈরি হয়। সেখানকার রাজার কানে এই খবর পৌঁছোনো মাত্রই, ভ্যালেন্টাইনকে বিষপানে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে এক চিঠি লেখেন, যাতে চিঠির শেষে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সেই থেকে মানুষ তার নামটিকে ভালবাসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে। পরে পোপ গেলাসিয়াস দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ইতিহাসই সবার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।
মজার বিষয়, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কোনও দিন ব্যক্তি প্রেমের কথা প্রচার করেননি। ভালবাসাকে বেঁধে দেননি নারী-পুরুষের শরীরী ছন্দে। তার প্রচার এবং প্রসার ছিল জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানবপ্রেম নিয়ে। সেই ভালবাসাই বিবর্তনের ধারায় একেবারে ব্যক্তি পরিধিতে আটকে গেছে।
আবার কথিত আছে, রোমের একটি উৎসবের নাম- লুপারকেলিয়া, যা ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়৷ যা আসলে তাদের দেশে বসন্তের আনুষ্ঠানিক সূচনা হিসেবে ধরা হয়। সেখানে একটা রীতি রয়েছে, যে একটি বক্স থেকে কোনও ছেলে বা মেয়ে একটি নাম তুলবেন।
ছেলেটি যে মেয়েটির বা মেয়েটি যে ছেলেটির নাম তুলবেন, তারা এই উৎসবের সময়ে একে অপরের প্রেমিক বা প্রেমিকা হিসেবে পরিচিত হবেন। এমনকি তারা বিয়েও করতে পারেন। রোমের এই উৎসবকে পরে রোমের চার্চ খ্রিস্টানদের উৎসব হিসেবে ঘোষণা করে।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে, সেই উৎসবের সঙ্গে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের ফাঁসির ঘটনা মিলেমিশে যাওয়াতেই উৎসবের নামও হয়ে যায় ভ্যালেন্টাইন্স ডে। যেহেতু উৎসবটি ছিলো এক অর্থে ছিলো প্রেম-ভালোবাসার, তাই সময়ের বিবর্তনে সেটি হয়ে যায় ভালোবাসা দিবস।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রেম নিবেদনের জন্য ‘ভালোবাসা’ শব্দটি প্রেমের কবিতা-গল্পে ব্যবহার হতো। ভ্যালেন্টাইন নামসহ বেশ কয়েকটি বই আঠারো শতকে প্রকাশিত হয় এবং এটি তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি লেখাগুলো শুভেচ্ছা কার্ডে রূপ নেয়।
ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে দুটি বিখ্যাত সাহিত্যিক গল্প রয়েছে। প্রথমটি হল ১৩৮২ সালে প্রকাশিত চসারের ‘পার্লামেন্ট অব ফউলাস’। যেখানে তিনি লেখেন, এটা হল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে, যখন প্রতিটি পুরুষ পাখি তার মেয়ে পাখি খুঁজতে আসে।
আরেকটি সাহিত্যকর্মকে কেন্দ্র করে পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎপত্তি বা জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে ধরা হয়। ১৪১৫ সালে অর্নলসের রাজকুমার চার্লস এগিনতোনিয়া যুদ্ধে হেরে লন্ডন টাওয়ারে বন্দী থাকা অবস্থায় তার প্রিয়তমাকে এক চিঠি লিখেছিলেন। এরপর উইলিয়াম শেক্সপিয়র তার লেখনীতে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’কে জনপ্রিয় করে তোলেন।
মূলত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে উপহার দেয়া নেয়ার প্রচলনটা বেড়ে যায়। এটি তখনও পশ্চিমা দুনিয়াতেই আবদ্ধ ছিলো। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হাতে লেখার বদলে প্রিন্ট করা কার্ড জনপ্রিয়তা পায়। আবার ডাক পরিবহণ খরচও কমে যায়।
ফলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। চকলেট ও গোলাপ উপহার হিসাবে ঢুকে পড়ে এরমধ্যে। এক হিসাবে, বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় এক বিলিয়ন কার্ড বিক্রি হয়। এভাবেই বিশ্বায়নের যুগে ভালোবাসার বাণিজ্যকরণের সূচনা হয়, যা সময়ের সঙ্গে আরও বাড়ছে।