সেলিম রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বাসিন্দা। ২০১২ সালে চাকরি থেকে অবসরে যান। আর ২০১৪ সালে তার স্ত্রী মারা যান। এরপর তিনিও শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত (প্যারালাইজড) হয়ে হারিয়ে ফেলেন চলাফেরার শক্তি। জীবনের অন্ধকার অধ্যায় তখন থেকেই শুরু।
ওই সময় তার দুই মেয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে চাকরি করতেন। কিন্তু বৃদ্ধ পিতার অসহায় অবস্থায় তারা পাশে দাঁড়াননি। উল্টো চাকরিজীবী মেয়েরা চিকিৎসার কথা বলে বাবার অবসর ভাতার সব টাকা তুলে নিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে যান। বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমে শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছেন এই শিক্ষক।
Advertisement
সেলিম বলেন, তিনি প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে তার দুই মেয়ে তাকে ভারতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে চান। এরপর তার নিজের জমানো টাকা ও পেনশনের টাকা তুলে মেয়েদের হাতে দিয়ে দেন। এরপর সেই টাকা নিয়ে দুই মেয়ে তাকে ফেলে যান চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারে।
এই কেয়ার সেন্টারে ২০১৭ সালে যখন সেলিমকে নিয়ে আসা হয় তখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে তার দুই মেয়ের বিষয়ে খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি। তত দিনে তারা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন । আজ পর্যন্ত তার খোঁজ নিতে আর কেউ আসেননি বলেই জানালেন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের ম্যানেজার মিরাজ হোসেন।
মেয়েদের কথা মনে করতেই চোখ পানিতে ভরে যায় এই শিক্ষাগুরুর। কণ্ঠ অনেকটা ভারী হয়ে উঠে। তবুও বলতে থাকেন, তিনি সুস্থ থাকা অবস্থাতেই তার দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের স্বামীরা চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করে। তাদের ঘরে সন্তান আছে। তারা জানে তাদের বাবা ঢাকায় আছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে কেউ তাকে দেখতে আসেনি। একবারের জন্য ফোনও করেনি। এখন আর কারও সঙ্গেই যোগাযোগ নেই।
Advertisement
জীবনের শেষ সময়ে সেলিমের মনে অনেক অভিমান জমেছে। তাই পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চান না সেলিম। কারও সংসারে থাকতে চান না বোঝা হয়ে। কেউ নিতে আসলেও যাবেন না। বললেন, এখানেই অনেক ভালো আছেন।
অনেক ইচ্ছে ছিল নিজের গড়া ভিটায় জীবনের পুরো সময়টা কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু ভাগ্য সবসময় সবার পক্ষে থাকে না। যে সন্তানদের নিজের কষ্টের টাকায় বড় করে চাকরি পর্যন্ত পাইয়ে দিয়েছিলেন, সেই সন্তানরাই তাকে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। জীবনের এই অন্তিম সময়ে পৃথিবীটাকে অভিশপ্ত মনে হচ্ছে সেলিমের। তাই শত কষ্টেও অভিমানগুলো নিজের কাছেই জমা করে রাখছেন। কারো কাছে কোনো অভিযোগ করতে চান না। শুধু চান, তার মেয়েরা যেন ভালো থাকে, তাদের যেন এমন অবস্থায় কখনো পড়তে না হয়।
মানবসেবায় প্রায় এক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছেন ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার। পেশায় তিনি একজন নার্স। এই প্রতিষ্ঠানে মূলত রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ ও শিশুদের তুলে এনে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পুরো দায়িত্ব নেয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মিরাজ হোসেন জানান, ৯৯৯ থেকে, বিভিন্ন ব্যক্তির ফোন বা পুলিশের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে অসহায় ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে আসা হয়। এখানে বর্তমানে প্রায় ১৫০ জন বৃদ্ধ, ৪০ জনের মতো শিশু রয়েছে। তাদের দেখভালের জন্য সবমিলে ৬০ জন লোক কাজ করছে। এতে বাসা ভাড়া, খাবার, ওষুধ, বেতনসহ মাসে প্রায় ২৮ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে ওষুধের পেছনে মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। এই বিশাল অঙ্কের ব্যয় মেটাতে কখনো তাদের হিমশিম খেতে হয়।
বর্তমানে সাভারে জায়গা কিনে সেখানে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। খোলামেলা জায়গা হওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধরা সেখানে থেকে স্বস্তিবোধ করবে বলে জানালেন মিরাজ হোসেন। পাশাপাশি মানবতার পাশে সবাইকে দাঁড়াতে অনুরোধ তার।
বয়স্ক ব্যক্তিরা, পুরুষ ও নারী উভয়ই সমাজে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়, প্রধানত তাদের বয়স ও দারিদ্র্যের কারণে। বয়স্কদের নির্যাতন, বিশেষ করে অবহেলা, আর্থিক বা মানসিক দুর্ব্যবহার আজকাল বাংলাদেশে অনেক সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি লোকের বয়স ৬০ এর বেশি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৮%। ৬০ বছরের বেশি বয়সী ৩৬ মিলিয়ন লোকের সঙ্গে ২০৫০ সালে বয়স্ক মানুষের অনুপাত দ্বিগুণ হয়ে ২১.৯% হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তার মানে, প্রতি পাঁচজন বাংলাদেশির জন্য একজন প্রবীণ নাগরিক হবেন এই সময়ের মধ্যে।