ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,সোমবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : ২০২২ সালের জুনে প্রকাশিত ব্র্যাকের শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (আইইডি) তথ্য জানাচ্ছিল যে, করোনার সময়ে মাদ্রাসা ছাড়া দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের করা শুমারি ২০২১ থেকেও প্রায় অনুরূপ তথ্য পাওয়া যায়। পরে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) অপর এক সমীক্ষার তথ্য থেকে জানা যায়, ওই সময়ে মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী ভর্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে। আর অতি সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যও বলছে, করোনার সময় সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা লক্ষ্যযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
উপরোক্ত পরিসংখ্যানসমূহকে একসাথে করে বিশ্লেষণ করলে ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, করোনা দেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক সামর্থ্যকে এতটাই কমিয়ে দিয়েছে যে, শিক্ষার মতো মৌলিক প্রয়োজনের বিষয়টিকেও তারা বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এ আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার না কমে বরং বেড়ে গিয়েছে, যা সমাজ-মানুষের সর্বশেষ মানসিক গঠনপ্রবণতার একটি বিশেষ দিককেই নির্দেশ করছে, যেটি খুবই উদ্বেগজনক। তৃতীয়তঃ উল্লিখিত তিনস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনুপাতিক হারে শিক্ষার্থী ভর্তি সবচেয়ে বেশি কমেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্তরে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, অর্থনৈতিক সঙ্কটের ধাক্কাটি তৃণমূল পর্যায়কেই আক্রান্ত করেছে সবচেয়ে বেশি।
বিজ্ঞাপন
করোনার সময় অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা কমে গিয়েছিল। ধারণা করা হয়েছিল, করোনা কেটে গেলে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন যে সঙ্কটময় পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটিতো নিঃসন্দেহে করোনাকালের চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। ফলে এ আশঙ্কা করাই যেতে পারে যে, আসন্ন বছরগুলোতে দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থী ভর্তির হার আরও ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে। সেক্ষেত্রে তা যে সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের উপর ব্যাপকভিত্তিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাতে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন, তা তাদের আচরণ দেখে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।
করোনা শুরু হতে না হতেই বিভিন্ন খাতের জন্য দফায় দফায় বিপুল পরিমাণের প্রণোদনা তহবিল বরাদ্দ করা হলো এবং এই সুযোগে অনেকে তা লুটপাট করেও নিলেন। খাতওয়ারি প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা কর্মসূচিও গ্রহণ করা হলো। কিন্তু সেসবের তুলনায় শিক্ষাখাতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেকটাই সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’র ‘লেখাপড়া শিখে যেই, অনাহারে মরে সেই’র মতো। আর শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে এই যদি হয় রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে ব্যবসায় ও মুনাফাকে সম্প্রসারণ করতে যেয়ে শিক্ষা অনেকটাই অপাঙতেয়, সেখানে করোনাকালে বিদ্যায়তনে শিক্ষার্থী ভর্তির হার যদি এরচেয়েও বেশি কমে যেত, তাহলেও এতটুকু অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। কিন্তু ততটুক যে কমেনি তার সবচেয়ে আগে কারণ হচ্ছে পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ দেশের সাধারণ মানুষের ধৈর্য্য ও সাহস। কিন্তু ধৈর্য্যশীলদের তুলনায় সুবিধাবাদী লোভীরাই যখন রাষ্ট্রের কাছে অধিক আদরণীয়, তখন শুধু ধৈর্য্যের উপর ভরসা করে সামর্থ্যহীন ব্যক্তি মানুষ আর কতটাই-বা এগুতে পারে?
বিজ্ঞাপন
দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট আরও প্রলম্বিত হলে, যা হওয়ার আশঙ্কাই সর্বাধিক, উপরোল্লিখিত মানুষরা বিদ্যমান অর্থনৈতিক স্তরে টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। আর তা না পারলে নিকট ভবিষ্যতের দিনগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির হার আরও কমে যাওয়াটা প্রায় অবধারিত। সেক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা কর্তৃপক্ষ কি সাধারণ মানুষের প্রতি করুণাবশত হলেও বিষয়টি নিয়ে খানিকটা ভাববেন? জাতীয় সংসদে কত অবান্তর বিষয় নিয়ে কথা হয়। বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাতেও সেখানে অনেক সময় কাটে। তো, দেশের বিদ্যায়তনগুলোতে যে এভাবে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে উপায় খোঁজার একটু আলোচনা কি সেখানে হতে পারে না? আমাদের জাতীয় সংসদ কি তাহলে এতটাই অকার্যকর প্রতিষ্ঠান?