https://www.youtube.com/live/rBsCek9tst8?feature=share
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,রোববার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ : এই নির্বাচন কি আগামী নির্বাচন কেমন হবে তার একটি ইঙ্গিত দেয়? এ প্রশ্ন নিয়ে এরইমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না যায় সেক্ষেত্রে দলটির নেতাদের কেউ কেউ কি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বিএনপি’র সংশ্লিষ্ট সূত্র ইতিপূর্বে জানিয়েছিল, দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছিল। এজন্য কমিটিতে বড় নামের চেয়ে দলের প্রতি আনুগত্য বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বহুক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয় সাবেক ছাত্র নেতাদের। তবে এতেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল ঠেকানো যাবে তার নিশ্চয়তা সম্ভবত নেই।
Advertisement
করোনার তখন বাড়-বাড়ন্ত। লকডাউন। ঘরবন্দি মানুষ। এ সময় ফেসবুকে কয়েকটি লাইভ শো উপস্থাপনা করেন ক্রিকেট তারকা তামিম ইকবাল। দেশ-বিদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে আড্ডায় মাতেন তিনি।
এমনই একটি আড্ডায় কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে যোগ দেন খ্যাতিমান কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। কপিল শর্মার অনুকরণে তাকে একপর্যায়ে তামিম জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা আপনি কি কখনো ভেবেছেন আমার শো’তে আসতে পারবেন!
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই- এ কথাটি প্রায় শোনা যায়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আমরা তার বেশকিছু দৃশ্যপটও দেখেছি। এক্ষেত্রে অন্তত দুটি ঘটনা অভাবনীয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উকিল আব্দুস সাত্তারের কথাই ধরা যাক না কেন। ছিলেন বিএনপি’র এমপি। এক-দুই বার নয়, পাঁচবার সংসদে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তার। ছিলেন খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভারও সদস্য। বয়োবৃদ্ধ সাত্তার সাহেব একা একা চলাফেরাও করতে পারেন না। দলের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে সম্প্রতি তিনি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু চমক দেখাতে একদমই সময় নেননি। ক’দিন পরই পদত্যাগ করেন বিএনপি থেকে। গুঞ্জন শুরু হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে উপনির্বাচনে লড়বেন তিনি। এতটুকুও না হয় চলে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হন তিনি। অবিশ্বাস্যভাবে আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়। একে একে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ভয়ে-চাপে আত্মগোপনে চলে যান এক প্রার্থী। এটাও সবার জানা, উকিল আব্দুস সাত্তার ফের নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এত কিছুর পরও তার আসনে ভোট পড়েছে ১৬ শতাংশের মতো। না এতে আইনগতভাবে নির্বাচন বৈধ হতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বার বার নির্বাচিত এক এমপি’র এত কম ভোট পাওয়া ভালো কোনো ইঙ্গিত বহন করে না। কি জানি আয়নায় তিনি নিজের চেহারা দেখেন কিনা। তবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে হাসিমুখে সাত্তারের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন এমনটা নয়। পত্রিকায় পড়ছিলাম, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে তারা ভোটে সাবেক এই বিএনপি নেতার পক্ষে ছিলেন। আগামী নির্বাচনেও নিজেদের বঞ্চিত হতে হবে এমন একটা শঙ্কাও রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে।
Advertisement
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল এ ভোটের কেন্দ্রীয় চরিত্র উকিল আব্দুস সাত্তার। এমনকি অনেকে আগ বাড়িয়ে এটাও বলছিলেন, আগামী নির্বাচনও হতে পারে সাত্তার মডেলে। তবে ভোটের দিন ছয় আসনের এই উপনির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন হিরো আলম নামে পরিচিত আশরাফুল আলম। তার জীবনের গল্প প্রায় সবারই জানা। কেউ তার সমালোচক। কেউবা তার প্রচেষ্টার প্রশংসাকারী। কিন্তু একটা ভোটের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হবেন হিরো আলম এটা সম্ভবত কেউই ভাবেননি। দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি। লড়াইয়ে নামার রাস্তাও অবশ্য তার জন্য সহজ ছিল না। হাইকোর্টে যেতে হয়েছিল তাকে। উচ্চ আদালতের নির্দেশেই তার মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয়। একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি হিরো আলম। তার অভিযোগ ওই আসনের বেশির ভাগ কেন্দ্রই দখল হয়ে যায়। অন্য আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান তিনি। এ হার অবশ্য মানতে রাজি নন হিরো আলম। তার দাবি, শিক্ষিত লোকরা তাকে ‘স্যার’ বলতে রাজি নন। তাই তাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ জিয়া হাসান হিরো আলমের এ বক্তব্যের তুমুল প্রশংসা করেছেন। ওদিকে, প্রথম আলো’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হিরো আলম বলেন, ‘এ আসনে ভোট চুরি হয়নি, লজ্জাজনকভাবে ফলাফল চুরি হয়েছে। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেন্দ্রে গিয়ে আমাকে বিপুল ভোট দিয়েছেন। কিন্তু তথাকথিত শিক্ষিত কর্মকর্তারা আমার মতো অশিক্ষিত মূর্খ ছেলেকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে, এতে তাদের মানসম্মান থাকবে না, শুধু এই কারণে মুহূর্তের মধ্যে ফলাফল পাল্টে দিয়েছেন। কেন্দ্রের ফলাফল নির্বাচনী এজেন্টদের কাছে সরবরাহ করার কথা থাকলেও বেশকিছু কেন্দ্রে আমার এজেন্টদের কাছে ফলাফল সরবরাহ করা হয়নি। আবার নন্দীগ্রাম উপজেলায় স্থাপিত নির্বাচন কমিশনের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ফলাফল ঘোষণার সময় ৪৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১ থেকে ৩৯টি কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা করা হয়। একতারার বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর হঠাৎ ফলাফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হয়। কিছু সময় চুপচাপ থাকার পর ১০ কেন্দ্রের ফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা না করে হঠাৎ জাসদের প্রার্থী এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের মশাল প্রতীকে বেশি ভোট দেখিয়ে বিজয়ী করা হয়। ১০ কেন্দ্রের ফলাফল কেন্দ্রভিত্তিক ঘোষণা না করার কারণ কী? একটি কেন্দ্রে মশাল প্রতীকে ভোট পড়েছে ২৮, অথচ গণনার সময় বেশি ভোট দেখানো হয়েছে। আরেকটি কেন্দ্রে একতারায় ৩০৭ ভোট পড়েছে, গণনার সময় ৭ ভোট দেখানো হয়েছে। নির্বাচনী এজেন্টদের ডেকেছি। সব তথ্যপ্রমাণ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করবো। ফলাফল পাল্টিয়ে আমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছে, সেটা দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করেই ছাড়বো।’ তবে হিরো আলমের এ বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, হিরো আলমের অভিযোগের ভিত্তি নেই।
Advertisement
ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে অবশ্য সামগ্রিকভাবে খুব একটা নতুন কিছু দেখা যায়নি। ৩০ শতাংশের কম ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কেন্দ্র ভর্তি ভোটার- সে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আর ফেরেনি। বাদশাহী নিয়েও অবশ্য অনেকদিন ধরে লেখা হয় না। একসময় তাদের বলা হতো, একদিনের বাদশাহ। সেদিন আর নেই। ‘অভিমানী’ ভোটারদের ফেরাতে মাইকিংয়েও কাজ দেয়নি। ভোটে নানা অনিয়মের খবর, বিশেষ করে বুথে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির খবর মিডিয়ায় এসেছে। তবে নির্বাচন কমিশন সাম্প্রতিক অতীতের মতো এ নিয়ে কোনো অ্যাকশনে যায়নি। বরং কমিশনকে সামগ্রিকভাবে সন্তুষ্টই মনে হয়েছে। অন্তত নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানার কথায়।
সর্বশেষ উপনির্বাচন এটা আরও একবার দেখিয়ে গেল জনগণ ভোট নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয় এবং তারা প্রধান নিয়ামকও নয়। ৭০ শতাংশ, এমনকি তার চেয়ে বেশি ভোটার যদি ভোটদানে বিরত থাকে এতেও আইনি কোনো ব্যত্যয় নেই সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু নৈতিকতার একটি প্রশ্ন কি থেকে যায় না? অন্তত অর্ধেক ভোটার যদি তাদের মতামত না দেন সেখানে কি জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কেন এই ভোটাররা কেন্দ্রে আসেন না বা আসতে পারেন না তা বোধ হয় সবারই জানা। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা খুব একটা নেই। চলতি মডেলে হলে আগামী নির্বাচনগুলোতেও ভোটার সংখ্যা বাড়তে পারে এমন আশা খুব একটা নেই।
এই নির্বাচন কি আগামী নির্বাচন কেমন হবে তার একটি ইঙ্গিত দেয়? এ প্রশ্ন নিয়ে এরইমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না যায় সেক্ষেত্রে দলটির নেতাদের কেউ কেউ কি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। বিএনপি’র সংশ্লিষ্ট সূত্র ইতিপূর্বে জানিয়েছিল, দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছিল। এজন্য কমিটিতে বড় নামের চেয়ে দলের প্রতি আনুগত্য বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বহুক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয় সাবেক ছাত্র নেতাদের। তবে এতেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেল ঠেকানো যাবে তার নিশ্চয়তা সম্ভবত নেই।
গণতন্ত্রে জনগণই সর্বেসর্বা। সংবিধানও বলছে জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। কে না জানে জনগণের হয়ে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সে জনগণ উপেক্ষিত থাকলে গণতন্ত্র কতটা কায়েম সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। এটাও বলে রাখা দরকার, মুক্ত মানুষের বিরোধ নিষ্পত্তিতে সবচেয়ে উত্তমপন্থা ব্যালট। এর কোনো বিকল্প নেই। সংঘাত-সহিংসতা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। মতপ্রকাশের সমান সুযোগই গণতন্ত্রের ভাষা।