ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),মুরাদনগর প্রতিনিধি,শনিবার, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ : গুজবে গণপিটুনির নামে নিরীহ মানুষ হত্যা বেড়েই চলেছে। ‘গুজবকাণ্ডে’ সবশেষ সংযোগ, কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলায় দারোরা ইউনিয়নের পালাসুতা গ্রাম। বৃহস্পতিবার রাতে ডাকাত সন্দেহে তিন জনকে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এতে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত হন। অপরজনকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া, শুক্রবারও জেলার চান্দিনার মহাড়ং এলাকায় এক যুবকে ‘চোর সন্দেহে’ পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৭২ ঘণ্টায় কুমিল্লায় এ নিয়ে চার জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়।
নিহতরা হলেন— কাজিয়াতল গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে নুরু মিয়া (২৮), পালাসুতা গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন (২৭)। আহত হয়েছেন সদর দক্ষিণের কোটবাড়ী বাঘমারা গ্রামের সেলিম মিয়ার ছেলে শাহজাহান (২৮)।
স্থানীয় একাধিক সূত্র ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)-কে জানায়, এর আগে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও বৃহস্পতিবার রাতে কোথাও হয়নি। এমনকি, যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের ডাকাত বলে কেউ চিহ্নিতও করেননি। শুধু সন্দেহের বশে তিন জনকে গণপিটুনি দেন স্থানীয়রা। এতে দুজন মারা যান। তবে, কদিন আগে কাজিয়াতল ও পালাসুতা গ্রামে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার পর গ্রামের মসজিদে মসজিদে ‘ডাকাত আতঙ্কে’ মাইকিং করা হয়। এ ছাড়া, একই সময়ে পাশের এলাকার ওয়াজ মাহফিলেও একই ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে পুরো দারোরা ইউনিয়নে ‘ডাকাত গুজব’ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে গ্রামে প্রত্যেকে লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করেন। এরপরই ডাকাত সন্দেহে তিন যুবককে আটক করে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এতে দুই জন ঘটনাস্থলে মারা যায়। নিহত দুই জন সম্পর্কে শ্যালক-দুলাভাই। আরেক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এ ঘটনা নিয়ে জেলাজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই বলছেন, এই ঘটনার পেছনে ‘রাজনৈতিক ছায়া’ রয়েছে। কেউ—বা বলছেন, পেছনে আরও বড় রহস্য রয়েছে। এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে, এমন ঘটনাকে পুঁজি করে বড় ঘটনার ‘আয়োজন’ চলছে।
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার রহস্য উন্মোচনে ইতোমধ্যে কাজ করছে পুলিশের একাধিক টিম। তবে নিহত নুরু মিয়া ও ইসমাইলের পরিবারের দাবি, পূর্ব শত্রুতার জেরে পরিকল্পিতভাবে তাদের ঐ গ্রামে ডেকে পিটিয়ে হত্যা করেছে একটি প্রভাবশালী মহল।
একটি সূত্রের বরাতে জানা যায়, পালাসুতা গ্রামের এক সাবেক চেয়ারম্যান তাদের যেতে বলেছিল। কারণ ছিল মাদকের আড্ডা বা পার্টি। সেখানে তারা আট জন ছিল। এরমধ্যে পাঁচ জন পালিয়েছে। এলাকাবাসী আটক করলে, তাৎক্ষণিক তারা সদুত্তর দিতে পারেনি। এতেই সন্দেহ হয়। এরপর গণপিটুনি। প্রথমে কয়েকজন মিলে তিন জনকে আটক করে, বাকিরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলে আরও লোকজন আসতে থাকে। লাঠিসোটা দিয়ে বর্বরোচিত গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় তাদের।
শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে পালাসুতায় সরেজমিনে দেখা যায়, গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরো এলাকা পুরুষশূন্য। এলাকায় গণপিটুনিতে দুজন মারা গেছে— এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নারী বলেন, শীতের মৌসুমে আমাদের এলাকায় ডাকাতি হয়। কদিন আগেই ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। তাই, ডাকাতি ঠেকাতে এলাকাবাসী রাতে পালা করে পাহারা দিয়ে আসছিল।
এদিকে, নিহত ইসমাইল মা মনোয়ারা বেগম অভিযোগ করে বলেন, আমার ছেলেকে মিথ্যা অভিযোগে দোষী করা হয়েছে। অন্য কারও দোষ ছেলের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ছেলের চুরি করার কোনও রেকর্ড নেই। তারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।
কুমিল্লার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রোকেয়া বেগম শেফালী বলেন, মানবাধিকার দেশে নানা কারণে দিনকে-দিন মানুষ প্রতিহিংসাপরায়ণ হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অপরাধের চেয়ে অপরাধীদের প্রতি বাড়ছে ঘৃণার মাত্রা। বিচারকাজে ভরসা কমায়, মানুষ নিজেই যেন বিচার হাতে তুলে নিয়েছেন। এ যেন এক ভয়ঙ্কর পাগলকাণ্ড।
এ ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুক্রবার বিকেলে মুরাদনগর উপজেলা প্রশাসন থেকে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গুজব ছড়িয়ে ও গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। যারা নিশ্চিত না হয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, নিহত নুরু মিয়ার শ্বশুরবাড়ি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে দুরকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় ও কার বাড়িতে ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল- এমন কোনও তথ্য দিতে পারেননি। তাদের অতীত কর্মকাণ্ড যাচাই করা হচ্ছে। নিহতদের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (মর্গে) পাঠানো হয়েছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কুমিল্লা পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, আহত ব্যক্তিসহ সন্দেহভাজন একজনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কিছু জানতে পারেনি পুলিশ। তারা কেন এখানে এসেছেন, তাদের পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ খুব দ্রুতই জানার চেষ্টা করছে। তদন্ত চলমান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শীতে বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। এক্ষেত্রে কেউ ধরা পড়লে, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পুলিশকে জানাবেন। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ধারোরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কামার উদ্দিন খন্দকার ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, ঘটনার সময় আমি পাশের এলাকায় মাহফিলে অবস্থান করেছিলাম। এলাকাবাসী থেকে শুনতে পেয়েছি, তারা ডাকাতি করতে এসেছে। পরে পুলিশ এসে আহতদের উদ্ধার করে। কারা তাদের মারধর করেছে চিহ্নিত করতে পারিনি। ঘটনাস্থলে এসে কাউকে খুঁজে পাইনি। এ বিষয়ে আমি আর মন্তব্য করতে রাজি না। যেহেতু প্রশাসন এটা নিয়ে কাজ করছে।