ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,বুধবার , ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ; ঘটনার পর গেল ৬ বছর ৯ মাসের পুরো সময়টাই নাটকীয়তায় ভরা ছিল চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত মাহমুদা মিতু হত্যা মামলা। এর মধ্যেই প্রায় আড়াই বছর তদন্ত শেষে মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে মামলার
অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। যাতে আসামি মিতুর স্বামী, পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আকতারসহ সাতজন। বাবুল এক সময় ছিলেন মামলার বাদী। অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি হবে আগামী ১০ অক্টোবর।
বাবুল আকতারের স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয় ২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে, চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে। বাসা থেকে বেরিয়ে ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় মাত্র কয়েকশ গজ দূরে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে তাকে। বাবুলের ছেলে পড়তো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট
পাবলিক স্কুলে। তার বাসা ছিল ওআর নিজাম রোডের একটি ভবনে।
ঘটনার সময় বাবুল আকতার কর্মরত ছিলেন ঢাকায়, যার কয়েকদিনের মধ্যে তার যোগ দেওয়ার কথা ছিল রংপুর পিবিআইয়ে। তার স্ত্রীকে হত্যা ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামে ছুটে আসেন তৎকালীন আইজিপি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব শীর্ষ কর্মকর্তা ও মন্ত্রী। তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারাদেশে।
ঘটনার পর বাবুলের উদ্ধৃতি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে জঙ্গিরা। যেহেতু বাবুল কয়েকটি জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ছিলেন, তাই তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়। এরপর সারাদেশে চলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান।
মামলাটি প্রথমে তদন্তের দায়িত্ব পায় থানা পুলিশ। এরপর যায় ডিবির হাতে, আটক হয় সন্দেহভাজন কয়েকজন। তবে ঘটনার জট খুলতে শুরু করে ভোলা, ওয়াসিম, শাহজাহানসহ কয়েকজন আটকের পর। আলোচিত হতে থাকে বাবুলের এক সময়ের সোর্স কামরুল সিকদার মুসার নাম।
এর আগে ২০১৬ সালের ২৪ জুন শ্বশুরের বাসা থেকে ঢাকা ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেয়া হয় বাবুল আকতারকে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় টানা ১৫ ঘণ্টা। এরপর আবারও তাকে শ্বশুরের বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়। ওই জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ বাহিনী থেকে অব্যাহতি নেয়ার আবেদন দেন বাবুল। যাতে
তিনি উল্লেখ করেন, স্ত্রী হত্যার ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ও সন্তানদের দেখভালের জন্য অব্যাহতি নিতে চান তিনি।
তবে একই বছরের ৩ আগস্ট এক দফায় চাকরি ফিরে পেতে আবেদন করেন বাবুল। এরপর ৯ আগস্ট যান মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তার এই আবেদন গ্রহণ করেনি মন্ত্রণালয়।
ঘটনার পর থেকে দুই সন্তান নিয়ে শ্বশুরের বাসায় থাকতেন বাবুল। তবে কিছুদিন পর চলে যান আলাদা বাসায়। চাঞ্চল্যকর এ মামলার মোড় ঘুরে যেতে থাকে মিতুর বাবার অভিযোগের পর। ২০২১ সালে তিনি দাবি করেন, বাবুলই হত্যা করিয়েছে মিতুকে। এরপর কয়েকবার বাবুলকে চট্টগ্রামে ডেকে
কথা বলেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এর মধ্যে আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত ভার পায় পিবিআই। এই নাটকীয়তার মধ্যে ২০২১ সালের মে মাসে বাবুলকে ডাকা হয় চট্টগ্রামে, পিবিআই অফিসে। একই সময়ে মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেন, বাবুলসহ ৮ জনকে আসামি করে দায়ের করেন আরেকটি মামলা। বাবুল আকতারের দায়ের করা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ১২ মে গ্রেপ্তার হন বাবুল। তদন্ত মোড় নেয় নতুন গন্তব্যে।
তবে মিতু হত্যা মামলা নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়, গত ৮ সেপ্টেম্বর বাবুল আকতারের একটি আবেদনের পর। চট্টগ্রামের আদালতে দেয়া আবেদনে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হেফাজতে রেখে নির্যাতন ও স্বীকারোক্তি আদায় চেষ্টার অভিযোগ তোলেন
বাবুল। দাবি জানান, কারাগারে নিরাপত্তার। তবে এ বিষয়ে আদেশ হবে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর।
নানা নাটকীয়তার মধ্যে মামলাটির অভিযোগপত্র দেয়া হলেও, রহস্য রয়ে গেছে আসামি মুসাকে ঘিরে। কেননা, ছয় বছরেও তার কোনও হদিস মেলেনি। অথচ, তাকে পাওয়া গেলে মিলত অনেক প্রশ্নের জবাব। যেমন, অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মিতু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বাবুল আকতার।
গায়েত্রী সিং নামে এক বিদেশি নারীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে পারিবারিক কলহের কারণে মুসাকে দিয়ে বাবুল খুন করান তার স্ত্রীকে। এ জন্য এক বন্ধুর মাধ্যমে মুসাকে ৩ লাখ টাকা দেন বাবুল।
পিবিআই বলছে, বাবুলকে দেয়া গায়েত্রীর একটি বইয়ে হাতের লেখা ও টাকা লেনদেনের কিছু তথ্য প্রমাণই খুলে দিয়েছে মামলার তদন্তের জট। যাতে খোলাসা হয়েছে হত্যার কারণ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে। পুরো ছকই স্পষ্ট হয়েছে তাদের তদন্তে।
পুলিশে ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন বাবুল আকতার। সহকারী কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর থেকে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পর্যন্ত চাকরির বেশিরভাগ সময়েই কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে। স্ত্রী হত্যা মামলায় বর্তমানে আটক আছেন ফেনি কারাগারে।