ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল ২০২২ : পিঠ জুড়ে বড়শি গাঁথার দাগ। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন বলে দিচ্ছে ত্যাগের মহিমার কথা। শুধু বড়শি গাঁথাতেই থেমে থাকা নয়, পুরো প্রক্রিয়াটি আরও জটিল, আরও কষ্টকর।
পিঠে বড়শি গেঁথে উড়তে হয় শূন্যে। শূন্যে ঝুলে ঝুলেই চলে ঈশ্বরের প্রার্থনা। গত ৪০ বছর ধরে প্রতিবছর এভাবেই পিঠে বড়শি গেঁথে চড়ক গাছে ঝুলে চারদিক প্রদক্ষিণ করেন নিতাই চন্দ্র সরকার।
ঢাকার ধামরাইয়ের কান্দিরকুল গ্রামের বাসিন্দা নিতাই। তবে বছরের এই সময়টাতে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন। এজন্যে এক মাস ধরে নিরামিষ ভোজন করেন। পাঁচ দিনব্যাপী পূজার সময়ে নিজের বাড়ির অন্ন গ্রহণ করেন না তিনি। থাকেন গোসলহীন এক কাপড়ে।
পয়লা বৈশাখের ৩ দিনে আশপাশের আরও হিন্দু প্রার্থনাকারীদের নিয়ে শুরু করেন বাড়ি বাড়ি ঘোরা। প্রথম দিন দেল যাত্রা, দ্বিতীয় দিনে শিব-পার্বতী নাচানো, বাইদানি নাচ ও রাতের বেলা ধুপ নাচ, হাজরা। ধুপ নাচের পর শ্মশান থেকে মৃতদের মাথার খুলি এনে নাচা হয় হাজরা। সেখানে কালী সেজে অপশক্তি বধ করেন সন্ন্যাসীরা। রাতভর নাচের পর আসে পয়লা বৈশাখ। সাধারণত পয়লা বৈশাখের দিনেই চড়ক গাছে বড়শি ঘোরানো হলেও ধামরাইয়েরটা হয় একদিন পরে।
সন্ন্যাসী নিতাইকে খুঁজে পেতে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে হয়েছে কয়েকটা গ্রামে। বিকেলের দিকে দেখা হওয়ার পর প্রথম প্রশ্ন ছিল এতো ভয়ংকর কাজ। ভয় করে না? এতো বড় বড়শি গাঁথা হয় ব্যথা পান না? হাসিমুখে তার উত্তর, ‘ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন হলে এসব কিচ্ছু না। আমার কিছুই হয় না।’
প্রতিবছরের মতো এবারেও ধামরাইয়ের যাত্রাবাড়ী মাঠে চড়কগাছ পূজা আয়োজন করা হবে। এই পূজার সব আচার পালন করবেন নিতাই চন্দ্র সরকার। সবশেষে পিঠে বড়শি গেঁথে শূন্যে উড়ে ৭ পাক থেকে ২১ পাক ঘুরবেন তিনি।
নিতাই চন্দ্র সরকার জানালেন চড়কগাছ পূজার আদ্যোপান্ত। তিনি বলেন, ‘আমার চার পুরুষ এই আচার পালন করে এসেছে। হিসাবে বলা যায় প্রায় ২০০ বছর আমরা এই পূজা করে আসছি। আমার বাবা করতে পারেননি। দাদুর পরে আমি ১২ বছর বয়স থেকে আবার শুরু করি। ৪০ বছর ধরে টানা আমি এই পূজা করে আসছি।’
নিতাই চন্দ্র সরকারের কাছে পূজার ইতিহাস জানতে চাইলে হেসে উত্তর দেন তিনি। বলেন, ‘আমি তো পড়াশোনা জানি না। আমার পূর্বপুরুষরা হয়তো জানতেন। বাবাও জানতেন। তবে আমার জানা নেই। শুধু এটা বলতে পারি, এই পূজার সময়ে আমি এক অন্য আধ্যাত্মিক জগতে চলে যাই। ঈশ্বরের জন্যে নিজেকে একদম সপে দেই। এ কারণে কোন ব্যথা বা কোন অনুভূতিই হয় না। আমি আলাদা এক মানুষ হয়ে যাই।’
কলকাতার আকাদেমি অব ফোকলোর থেকে প্রকাশিত দুলাল চৌধুরীর ‘বাংলার লোক সংস্কৃতির বিশ্বকোষ’ থেকে চড়ক পূজার ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, হিন্দু শাস্ত্রের কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা যেটি বর্তমান ভারতের গুজরাতের দ্বারকা নামে পরিচিত। সেখানকার তৎকালীন প্রধান দ্বারকাধীশের সঙ্গে যুদ্ধে শিব উপাসক বনরাজা ক্ষত বিক্ষত হন। পরে সেভাবেই মহাদেব শিবের প্রতি উপাসনা করে অমরত্ব লাভের জন্য নাচগান করেন। নিজের শরীরের রক্ত শিবের প্রতি সমর্পণ করেন। সেই ঘটনার স্মরণে এইদিনে শিব প্রীতির জন্য এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
ধামরাইয়ে চায়ের দোকান আছে নিতাই চন্দ্র সরকারের। সপ্তায় ছয় দিন চায়ের দোকান করেন। বাকি একদিন কামারি।
তিনি বলেন, ‘চড়ক পূজাকে সামনে রেখে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দেই। ঘুরে ফিরে মানুষ যা দেয় তাই খাই। সেটাও শুধু নিরামিষ। সন্ন্যাসীরা (সহযোগীরা) নাচেন। ভক্তরা নিজের সামর্থ্য মতো সিধা (চাল, অর্থ দান) দেয়। এছাড়া সারাবছর আমি কিছু কবিরাজি চিকিৎসা করি। তারাও সিধা দেয়। সেসব একত্র করে ভক্তদের জন্যে পয়লা বৈশাখের পরেরদিন পূজা শেষে ভোগের আয়োজন করি। তাদেরকে সেবা (খাওয়ানো) করাই। তখন আমি নিজেও আমিষ খাই।’
বড়শি গেঁথে পূজা করতে গিয়ে ব্যথা হয় কিনা বা কি অনুভূতি হয় এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর এই সময়ে আমি নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সপে দিতে প্রস্তুত হই। অনেকে বলে পিঠে ঘি মালিশ করি বা অন্য কিছু করি। কিন্তু আসল কথা হলো কিছুই করি না। বড়শি গাঁথার আগে আমি এমনিতেই প্রস্তুত হয়ে যাই। বড়শি গাঁথার আগে উপুড় হয়ে শুই। তখন থেকেই একরকম কোন অনুভূতি থাকে না। তখন বড়শি গাঁথা হয়। ব্যথা পেলে তো চিৎকার করে উঠতাম। কিন্তু কিছুই হয় না। রক্তাক্তও কিন্তু বের হয় না। যে ক্ষত হয়, সেটা সারতে একমাস সময় লাগে বড়জোর।’
কথা বলতে বলতে পিঠ ভর্তি বড়শি গাঁথার দাগ দেখালেন নিতাই চন্দ্র সরকার। বলেন, ‘পিঠে যে ক্ষত হয়েছে সেজন্যে কোন ডাক্তারি ওষুধ বা গাছ গাছন্ত খাই না। একমাসের মধ্যে একাই ঠিক হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস ঈশ্বর নিজে আমাকে ব্যাধি ছাড়া এটা সারিয়ে দেন। এজন্যে কারো কোন সহায়তাও লাগে না।’
নিতাই চন্দ্র সরকারের পরে এমন করে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে কেউ প্রস্তুত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো দাদুর কাছ থেকে শিখেছি। তারপর পালন করছি। পূর্বপুরুষদের রীতিকে আঁকড়ে ধরেছি। একইভাবে আমার ছেলে ও ভাতিজাও শিখছে। তারাও পালন করবে।’
রাতের ধুপ নাচ ও হাজরার আগে সন্ন্যাসীদের জন্যে দেবাধিদেব মহাদেব শিবের মন্দিরের ভেতরে খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছিল। অস্থায়ী চুলায় ফুলকো লুচি ভাজছিলেন বাড়ির নারীরা। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়েই কথা হচ্ছিলো নিতাই চন্দ্র সরকারের সঙ্গে। একপর্যায়ে লুচি খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানান তিনি।
পূজা করতে গিয়ে কখনো বাঁধা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যখন থেকে পূজার সময় শুরু হয়। হিন্দু-মুসলিম সবাই সহযোগিতা করে। উৎসাহ দেয়। চড়ক গাছে ঘোরানোর দৃশ্য দেখতে আসে হাজার হাজার মানুষ। তখন বিষয়টা যতটা না পূজার আচার থাকে, তারচেয়ে বেশি হয় উৎসব। সেখানে হিন্দু-মুসলিম সবাই আসে।’
নিতাই চন্দ্র সরকারের চাওয়া পূর্বজদের রেখে যাওয়া উৎসব আজীবন যেভাবে সবাইকে নিয়ে পালন করেছেন সেভাবেই পালন করে যাবেন। সেখানে ধর্ম নয়, উৎসবকে বড় করে দেখাতেই বেশি আনন্দ তার। এজন্যে এই ভয়ংকর সুন্দর আচারকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান তিনি।