লেগুনার সহকারী সেজে
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,সোমবার, ৩১ জানুয়ারি ২০২২ : গত শনিবার (২২ জানুয়ারি) ভোরে রাজধানীর হানিফ ফ্লাইওভারে পাওয়া যায় অজ্ঞাতনামা এক লাশ। লাশের রহস্য উদঘাটনে টানা চারদিন লেগুনার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। বারবার হতাশ হলেও শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন তিনি। হত্যায় জড়িত চার ছিনতাইকারীকে ইতোমধ্যে এনেছেন আইনের আওতায়।
একেবারে ফিল্মি স্টাইলে এই খুনের মামলার সমাধান করেছেন যাত্রাবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই বিলাল আল আজাদ। দৈনিক তিনশ টাকা পারিশ্রমিকে লেগুনার সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রাজধানীর রাস্তায়। তবে কিভাবে সমাধান হলো এই রহস্যের?
জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আজ থেকে চারদিন আগে। যেদিন ভোরে হানিফ ফ্লাইওভারে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। সেদিন সন্ধ্যায় মৃত ব্যক্তির ছেলে মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করে। জানা যায়, ওই ব্যক্তির নাম মহির উদ্দিন, বয়স ৫০। তিনি একজন মাছ বিক্রেতা। মহির উদ্দিন কীভাবে মারা গেলেন তা জানতে ফ্লাইওভারের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন আজাদ।
সেখানে দেখতে পান, একটি চলন্ত লেগুনা থেকে মহির উদ্দিনকে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই লেগুনার কোনো নম্বর প্লেট নেই। তবে পাদানির লাল রঙ নজর কাড়ে এস আই আজাদের। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর লাল পাদানির ওই লেগুনা খোঁজা শুরু করেন তিনি।
পরিচয় গোপন করে এক দালালের মাধ্যমে নিজের যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড, কোনাবাড়ী, ডেমরা, চিটাগাং রোড আর নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি রুটের একটি লেগুনায় চালকের সহকারীর কাজ নেন। শুরু হয় গোয়েন্দাগিরি। তার চেষ্টা ছিল চালক ও হেলপারদের সাথে মিশে হত্যার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা।
সেজন্য পরিবার বাদ দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হেলপারের ছদ্মবেশে তিনি সেই লাল পাদানির লেগুনার সন্ধান চালিয়ে যান। ‘দিন শেষে কাজের জন্য প্রতিদিন তিনশত টাকা মজুরিও পেয়েছি। প্রতিটা স্ট্যান্ডে লাল রঙের পাদানির ওই লেগুনা খুঁজে গেছি। কিন্তু না পেয়ে এক পর্যায়ে হতাশও হয়ে পড়েছিলাম।’- আজাদ জানান।
এক পর্যায়ে আজাদ নিজেই চালক হিসেবে কাজ করার জন্য লেগুনা আছে কি না, সেই খোঁজ করতে শুরু করেন লাইনম্যানদের কাছে। একজন তাকে জানান, ৭২৮ নম্বরের একটি লেগুনা রুটের সিরিয়ালে থাকলেও দুদিন ধরে সেটি দেখা যাচ্ছে না। সেটার খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে।
অনুসন্ধান করে আজাদ জানতে পারেন, লেগুনাটি কদমতলীর একটি গ্যারেজে আছে। সেখানে গিয়েই তিনি খুঁজে পান লাল পাদানির সেই বাহন। বিকল অবস্থায় গ্যারেজে পড়ে ছিল সেটি। তিনি বলেন, ‘ওই লেগুনার চালকের নাম ফরহাদ। সে মাদারীপুরে আছে জানতে পেরে চলে যাই সেখানে। কিন্তু সেখানে গিয়েও হতাশ হতে হয়।’
ফরহাদকে খুঁজে বের করা গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি দাবি করেন, গত ২১ জানুয়ারি দুপুরে তিনি লেগুনা বুঝিয়ে দিয়ে মাদারীপুরে বাড়ি চলে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, তার দাবি সঠিক। এসআই আজাদ পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ফরহাদ ঢাকা ছাড়ার পর লাল পাদানির ওই লেগুনা চালিয়েছিলেন মঞ্জু নামের এক চালক, তার হেলাপারের নাম আব্দুর রহমান।
‘এই তথ্য পাওয়ার পর ঢাকায় এসে মঞ্জু আর আব্দুর রহমানের সন্ধান শুরু করি। কিন্তু তাদের কোনো ফোন নম্বর না থাকায় সমস্যা হচ্ছিল।’ পরে আব্দুর রহমানের বাবার ফোন নম্বর পাওয়া যায় জানিয়ে আজাদ বলেন, ‘তার কাছে গিয়ে আমরা নিজেদের লেগুনার চালক ও মালিক হিসেবে পরিচয় দিই। তাকে বলি, তার ছেলে লেগুনার চাকা আর তেল বিক্রি করে দিয়েছে। পরে তার ছেলের সন্ধান জানতে চাওয়া হয়।’
‘রহমান এটা করতে পারে তা তার বাবা বিশ্বাস করতে চাননি। তবে তিনি ছেলেকে ডেকে আনেন। রহমানকে বুঝতে না দিয়ে আমরা তাকে ধরে ফেলি এবং মঞ্জুকে কোথায় পাওয়া যাবে জানতে চাই। পরে সে বলে, শান্ত নামের একজনের মাধ্যমে তাকে পাওয়া যাবে।’ পরে শান্তকে নিয়েই অভিযানে যায় পুলিশ। কিন্তু প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে আরেকবার চেষ্টা করে ধরা হয় মঞ্জুকে।
গত ২৬ জানুয়ারি তাদের গ্রেপ্তারের পর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মঞ্জু আর রহমান জানান, সেই রাতে তাদের সাথে রুবেল ও রিপন নামে আরও দুজন ছিল। পরে কদমতলী থেকে তাদেরও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এসআই আজাদ বলেন, ‘২১ জানুয়ারি রাতে লেগুনা নিয়ে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল ওই চারজন। মধ্যরাতে একজন যাত্রী তাদের লেগুনায় উঠলেও পরে বিপদ বুঝে চলন্ত লেগুনা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যান। পরে ভোরবেলা মহির উদ্দিন ওঠেন ওই লেগুনায়।’
‘মহির উদ্দিনের কাছ থেকে ৫ হাজার ৯০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে গাড়ি থেকে ফেলে দেয় ওরা। পরে সেই টাকার মধ্যে ৭০০ টাকার তেল কেনে। দুই হাজার টাকার ইয়াবা কিনে চারজনে মিলে সেবন করে। আর সকালে এক হাজার টাকার নাস্তা করে বলে জানিয়েছে মঞ্জু।’
পরিচয় বদলে অজ্ঞাতনামা খুনের অপরাধী ধরার অভিজ্ঞতা এবারই প্রথম নয় আজাদের জন্য। বছর পাঁচেক আগে ফেরিওয়ালা সেজে তিনি এক হত্যা মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছিলেন তিনি।