ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),রাজনৈতিক ভাষ্যকার,শনিবার, ০১ জানুয়ারি ২০২২ : জাতীয় সংসদে টানা দুই মেয়াদে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টি। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের পত্নী বেগম রওশন এরশাদ বর্তমান সংসদের বিরোধী দলের নেতা আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বিরোধী উপনেতার দায়িত্ব পালন করছেন।
গত একবছর ধরে অসুস্থতায় চিকিৎসাধীন থাকার কারণে রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় রওশন এরশাদ। কিন্তু বিরোধী উপনেতা ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিয়ে সংসদে ও সংসদের বাইরে রয়েছেন সক্রিয়। সংসদের বিরোধীদল হিসেবে জাতীয় পার্টি টানা দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করে আসলেও দলটি ‘সরকারের গৃহপালিত নাকি সত্যিকারের বিরোধীদল’ এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিনের।
সংসদের সাবেক বিরোধীদল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিক বিশ্লেষকসহ প্রশ্ন সবমহলেরই। সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকায় আছে কিনা মাঝে মাঝে প্রশ্ন তোলেন খোদ দলটির শীর্ষনেতারাও। বরং তার ভূমিকা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের কাছেই প্রশ্ন উঠেছে। সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে তারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জোরালো বক্তব্যও রেখেছেন। কেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এরশাদের মৃত্যুর পর দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে জিএম কাদের নিজেই জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে গৃহপালিত তকমা মুছে ফেলার চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বলেছিলেন, জাতীয় পার্টিই হবে সত্যিকারের বিরোধী দল। কিন্তু এই একবছরে কতটুকু করতে পেরেছেন তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, একবছর ধরে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে সরকারের কড়া সমালোচনায় লিপ্ত হলেও সরকারের রোষানলে যাতে পড়তে না হয় সেজন্য ব্যালেন্স রেখে চলেছেন। বরং এই এক বছরে নেতৃত্ব থেকেও জাতীয় পার্টিকে সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকায় নিতে পারেননি। পারেননি দীর্ঘদিনের বদমান ঘুচাতে। জনস্বার্থ বিষয় নিয়ে বিবৃতি ও ছোটখাট সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন ছাড়া সারাদেশে বড়ধরণের কোন কর্মসূচী দিতে পারেনি দলটি। পারেনি জনমত সৃষ্টি করতে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি নিয়ে নাম সর্বস্ব কর্মসূচী দিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিবৃতি ছাড়া তেমন মাঠে ময়দানে দেখা যায়নি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষনেতাদের।
শুধু কি তাই, জাতীয় সংসদে ও সংসদীয় কমিটিতে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যায়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত তারা সরকারি দলের পক্ষেই থাকছে।
২০২১ সাল জুড়েই রাজনীতির মাঠে বলতে গেলে বিরোধী দল ছিলো না। বিরোধী দল হিসেবে বিবৃতি-সভা-সমাবেশ করে সমালোচনা আর জাতীয় সংসদে ভূমিকা পালন করেছে জাতীয় পার্টি। কিন্তু জাতীয় পার্টি কতটা বিরোধী দল বা কতটা সরকারের অনুগত সে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। জাতীয় পার্টি এখন নিজেরাই নিজেদেরকে বিরোধীদল প্রমাণের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছেন। জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংসদের স্বীকার করেছেন যে, তাদেরকে সরকারের দালাল বলা হয়। এই দালাল খেতাব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জাতীয় পার্টি চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। বিরোধী দল হিসেবে দু-একটা বিষয়ে টুকটাক বক্তব্য রাখা ছাড়া কোনো ভূমিকাই পালন করতে পারেনি জাতীয় পার্টি। কাগজে-কলমে সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হলেও বাস্তবে মাঠে ময়দানে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তাই দীর্ঘদিনের গৃহপালিত বিরোধীদলের বদনাম মাথায় নিয়ে আলোচিত বছর ২০২১ পার করেছে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।
এই একবছরে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে আলোচিত নানা ঘটনা ঘটে গেছে। দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের অসুস্থতা, দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর মৃত্যু, মুজিবুল হক চুন্নুকে নতুন মহাসচিব নিয়োগ, দলীয় সাংসদ প্রফেসর মাসুদা রশীদের মৃত্যু, তৃণমূলে সাংগঠনিক কমিটি গঠন করতে না পারা, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নেতাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, বহিস্কার, পছন্দের নেতাদের পদোন্নতিসহ নানা ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল ঘোষণা করেন এরিক এরশাদের মাতা বিদিশা এরশাদ। এ ঘটনা জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে চলতি বছর আলোচিত ঘটনা।
সংসদে ও সংসদের বাইরে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলেছেন দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। দশম সংসদের সময় তিনি যখন দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন না তখন বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির রাজনীতি অস্পষ্ট। জাতীয় পার্টি ‘না সরকারি দল, ‘না বিরোধী দল।’ মানুষ আমাদের নিয়ে নানাভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে।
দশম সংসদে সত্যিকার বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে না পারায় আক্ষেপ ছিল জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। এজন্য একাদশ সংসদ নির্বাচনে জিতে সরকারে যোগ না দিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এরশাদ নিজেই হবেন বিরোধী দলীয় নেতা৷ জিএম কাদেরকে উপনেতা আর মশিউর রহমান রাঙ্গাকে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতিও পাঠান এরশাদ। ওই সময় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের বনানী অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সহিংসতা নয়, দেশ ও জনগণের কথা বলতেই সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হতে চায় জাতীয় পার্টি (জাপা)। সংসদ পরিচালনায় যেন কোন ঘাটতি না থাকে সেকথা বিবেচনা করেই জাপা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা রাখবে।
তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে দলের একাধিক সভায় জিএম কাদের বলেছেন জাতীয় পার্টিকে সত্যিকার বিরোধীদল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। আসলে হতে পেরেছেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি গত ৭ অক্টোবর একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাতকারে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী গণতন্ত্রের চর্চার অবকাশ শূন্যের পর্যায়ে বলা যায়। বিরোধী দল হিসেবে আমরা জনসমক্ষে কিছু সমস্যা তুলে ধরা, জনগণের কথা বলা… সেটি বলি। সরকারের শোনা-না শোনা তাদের নিজস্ব বিষয়। সরকারের কোনো জবাবদিহি করার সুযোগ কিংবা সুবিধা সংসদে নেই। ফলে প্রকৃত আর অপ্রকৃত যেই হোক, যখনই যে ছিল, যেভাবেই ছিল তারা কেউই কার্যকরভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। আমরা এর মাঝখান থেকে যতটুকু সম্ভব সেভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাতকারে জিএম কাদের জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি ‘না সরকারি দল, ‘না বিরোধী দল।’ আমরা কোথাও গেলে মানুষ আমাদের কথা শুনতে চায় না। আমাদের আমলে নেয় না। ভালো চোখে দেখে না। অনেকে তিরস্কার করে। আমাদের নিয়ে নানাভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। অনেকে বলে ‘আমরা গাছের উপরেরটাও খাই, তলারটাও কুড়াই।’ অনেকে আমাদের ‘দালাল’ বলে। আবার অনেকে এও বলেন, ‘আমরা গৃহপালিত বিরোধী দল।’ এসব কারণে আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। এ কারণে জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা দিন দিন তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই আমি বারবার বলছি জাতীয় পার্টির রাজনীতি অস্পষ্ট। অস্পষ্ট রাজনীতি দিয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা যায় না। তাই সবার আগে দলের রাজনীতি স্পষ্ট করতে হবে। এজন্য প্রথমেই সরকার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় পার্টিকে সংসদে এবং সংসদের বাইরে কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে এখন কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। সরকার ও বিরোধী দল একাকার হয়ে গেছে।
অতি সম্প্রতি সংসদে আক্ষেপ করে জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংসদ ও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক বলেছেন, জাপা যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকে তখন ভালো লাগে, আর যখন থাকে না, তখন হয়ে যায় স্বৈরশাসক।
মুজিবুল হক বলেন, গত মেয়াদে জাপা একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে ছিল। তখন অনেকে বলতেন, জাপা গৃহপালিত বিরোধী দল। এখন জাপা শুধু বিরোধী দলে, তা-ও বলে গৃহপালিত বিরোধী দল। তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমরা যাব কোথায়?’
জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলা যাবে কিনা- এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে জিএম কাদের বলেছেন- না, এখন আর জাতীয় পার্টিকে আমার মনে হয় না যে কেউ গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে মনে করে। এখন আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় ছিল যখন আমরা মন্ত্রী ছিলাম আবার একইসঙ্গে বিরোধী দল ছিলাম। সেই প্রেক্ষিতে এটা বলা যেতো। তবে এখন আমরা সত্যিকার অর্থে বিরোধী দলের কাজ করছি। আর বিরোধী দল হিসেবে প্রতিটি বিষয়ে আমাদের জোরালো ভূমিকা আছে।
দশম ও একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছে। দুই সংসদেই সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে সমালোচনার বদলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমর্থন দিয়ে গেছে বিরোধী দল। অনেক সময় প্রশংসা করেছে সরকার ও সরকার প্রধানকে। সরকারি দলও বিভিন্ন সময় বিরোধী দলের প্রশংসা করেছে। প্রায় প্রতিটি অধিবেশনে সংসদ নেতা ‘গঠনমূলক ভূমিকার’ জন্য বিরোধী দলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সরকারি দল সংসদে নিজেদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পাশাপাশি বাইরে থাকা বিএনপির সমালোচনায়ও ব্যস্ত থেকেছে।
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদও প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের পরিচয় স্পষ্ট করার দাবি করেছিলেন। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “তারা (জাপার এমপিরা) বিরোধী দল হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পান। কারণ, আমরা সরকারি দল, না বিরোধী দল- সাংবাদিকরা তা জানতে চান।”
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ঢাকাকে বাসযোগ্য করা, মাদক, পরিবেশ, খাবারে ভেজাল, বেকারত্ব—এই কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন। সব বক্তব্যেই তিনি কমবেশি সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসা করেছেন।
বিরোধী দলের একজন নারী সদস্য একাধিকবার সংসদে বলেছেন, নির্বাচন ছাড়াই তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরেক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান।
সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী দশম সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ওয়াকআউট করেছে ৩ বার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের বেতন–ভাতা বিল উত্থাপনের প্রতিবাদে তারা ওয়াকআউট করেন। তবে একাদশ সংসদে জাতীয় একবারও ওয়াক আউট করেছে বলে নজির নেই। অনেক বিষয়ে তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে বক্তব্য রেখেছেন। বিশেষ করে দলটির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ, মুজিবুল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারের সমালোচনা করেছেন। সবমিলিয়ে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে রাজনৈতিক মহলে।
সংসদে এবং সংসদের বাইরে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে দলটির চেয়ারম্যান ইতিপূর্বে বলেছেন, আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের যে ভূমিকা থাকার কথা, সত্যিকার অর্থে যদি কোনো মার্কিং সিস্টেম থেকে থাকে তাহলে জাতীয় পার্টি এক্ষেত্রে সব চেয়ে বেশি মার্ক পাবে। এর আগে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন আওয়ামী লীগ সংসদে কিছুদিন থেকেই চলে আসছে। কেন না ৯১ এর পর থেকে যে সংসদ তারা তৈরি করেছে সেখানে কথা বলা যায় কিন্তু কথা শোনানো যায় না। কাজেই সংসদে থেকে কি করবে? সংসদ বর্জন করেছে। যখন আওয়ামী লীগ সংসদে ছিল তখন বিএনপিও একই কাজ করেছে। সুতরাং সংসদে তারা কেউ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেনি। সংসদের বাইরে যে মারামারি, ভাঙচুর, হরতাল জনগণ এসব পছন্দ করতো না। সেটা করলেই যে ভালো বিরোধী দল হওয়া যায় সেটারও প্রমাণ হয়নি। কাজেই সংসদের বাইরে শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক যে আন্দোলন সেটা জাতীয় পার্টি করছে বিএনপিও করছে। সেখানে আমরাও বরং কারো চেয়ে কম করছি না।
জিএম কাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে এরশাদের সাবেকস্ত্রী বিদিশা এরশাদ জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নামে চলতি বছরের ৪ নভেম্বর এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন দল ঘোষণা করেন। নতুন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয় এরিকের মাতা বিদিশা এরশাদকে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করা হয় এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদকে।
জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সাংসদ জাফর ইকবাল সিদ্দিকী এ ঘোষণা দেন। জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বিদিশা এরশাদ বিভিন্ন কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন। বছরের শেষ দিকে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সাড়া পাওয়ার কথা জানান তিনি। দলের এরশাদ প্রেমিকদের সুসংগঠিত করে নতুন বছরে শক্তিশালী জাতীয় পার্টি উপহার দেবেন বলেও জানান তিনি।
বিদিশা বলেন, পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বিরোধী দলের নেতা পল্লীমাতা রওশন এরশাদ যেভাবে জাতীয় পার্টিকে ভালো বাসতেন, তাদের পথ অনুসরণ করেই সর্বস্তরের নেতাকর্মী নিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি উপহার দেবো।
এ বছরে দলটি হারান পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে। তিনি ২ অক্টোবর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। এছাড়া পার্টির সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা মাসুদা এমএ রশিদ চৌধুরী, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হাসান সিরাজ সুজাসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
তাছাড়া বয়সের কারণে চলতি বছর অসুস্থ হয়ে পড়েন বিরোধী নেতা বেগম রওশন এরশাদ। দীর্ঘদিন তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। উন্নত চিকিৎসার্থে পরে তাকে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে এয়ার এম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মারা যাবার পর কে হবেন তার উত্তরসূরী, তা নিয়ে নিজেদের মাঝে বিভেদে জড়িয়ে পড়েন দলটির শীর্ষনেতারা। পার্টিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপিকে পার্টির চেয়ারম্যান পার্টির মহাসচিব পদে নিয়োগের ইচ্ছা প্রদান করলে ফুসে ওঠেন অন্যান্য মহাসচিব প্রার্থীরাসহ সিনিয়র নেতারা। দল ভাঙ্গার হুমকিও আসে তাদের কাছ থেকে। মহাসচিব পদ নিয়ে এক পর্যায়ে পার্টির চেয়ারম্যানের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে জিএম কাদের সে যাত্রাই পিছু হটেন। শেষ মুহূর্তে দলের নতুন মহাসচিব হিসেবে পার্টির কো-চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নুর নাম ঘোষণা করে দলের বিভেদ সামাল দেন তিনি।
দলীয় সংসদ সদস্য মাসুদা এমএ রশিদ চৌধুরীর ইন্তেকালে তার আসন শূন্য হলে সেখানে এমপি নির্বাচিত হন জাপা চেয়ারম্যানের সহধর্মিনী ও জাতীয় সাংস্কৃতিক পার্টির আহবায়ক শেরিফা কাদের। দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি না থাকলেও মহিলা পার্টির অসংখ্য ত্যাগী নেতাকর্মী থাকা সত্বেও সংরক্ষিত আসনে নিজের স্ত্রীকে বেছে নেন তিনি। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও সমালোচনা রয়েছে।
রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ জাতীয় পার্টি দুটি কমিটির মেয়াদই উত্তীর্ণ হয়ে আছে। অধিকাংশ থানা কমিটির মেয়াদও নেই। পুরাণ নেতৃত্ব ও মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পাটি ছাড়া প্রায় সকল অঙ্গ সংগঠনই মেয়াদ উত্তীর্ণ। যদিও এবছর জাতীয় যুব সংহতির একটি আহবায়ক কমিটি দেওয়া হয়েছে। এর পূর্ণাঙ্গরূপ দিতেও সময় লেগেছে ছয় মাস। জাতীয় ওলামা পার্টি, মহিলা পার্টি, ছাত্রসমাজ প্রায় সবকটি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মাঠ পর্যায়ে নিজস্ব কোন কর্মসূচী নেই বললেই চলে। কেন্দ্র ঘোষিত ৮টি বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের মধ্যে প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপার খুলনা বিভাগীয় কমিটি বেশি সক্রিয় ছিল।
চলতি বছর পার্টি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় আলোচিত প্রেসিডিয়মি সদস্য পীরজাদা শফিউল্লাহ আল-মনিরসহ বেশ কিছু নেতাকর্মীকে। বিশেষ করে জাতীয় সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচন এবং স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ নিয়ে পরবর্তীতে সরকারদলীয় প্রার্থীর সাথে আঁতাত করে নিজ মনোনয়ন প্রত্যাহারে অভিযোগে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তাকুর রহমান মোস্তাক, লুৎফর রেজা খোকনসহ ৬ নেতাকে পার্টি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর নেতৃত্বে অতীতের সকল ব্যর্থতা মুছে নতুন বছরে নতুন জাতীয় পার্টি উপহার দেবে। তিনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দলকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।