ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,বৃহস্পতিবার, ০৭ অক্টোবর ২০২১ : রাজধানীর পল্লবী থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও নিজেদের শিক্ষা সনদ নিয়ে নিখোঁজ সেই তিন কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৪)। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টার দিকে পল্লবী থানা এলাকার নিজ নিজ বাসা থেকে স্নেহা আক্তার (১৬), কাজী দিলখুশ জান্নাত নিশা (১৫) ও কানিজ ফাতেমা (১৬) নামের তিন কলেজছাত্রী নিখোঁজ হয়।তাদের উদ্ধারের পর র্যাব জানায়, তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে দিনদিন লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত পারিবারিক বিধিনিষেধের ফলে একটা সময় তারা পরিবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে যায়।
তথ্য মতে জানা যায়, তারা মূলত উচ্চাভিলাসী জীবনযাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয় আসামিরা হলেন মো. তরিকুল্লাহ (১৯), মো. রকিবুল্লাহ (২০), জিনিয়া ওরফে টিকটক জিনিয়া রোজ (১৮) ও শরফুদ্দিন আহম্মেদ অয়ন (১৮)। এ ঘটনায় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ পুরো দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-৪-এর একটি গোয়েন্দা দল ছায়া তদন্ত শুরু করে। তথ্য মতে, দুই মাস আগে রাজধানীর দিয়াবাড়ী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামের এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। তিন বান্ধবী হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করে।হাফসার পরামর্শে পূর্ব পরিকল্পনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে, সেজন্য তারা নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক আইডি ও ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলীতে নষ্ট করে ফেলে। বুধবার (৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় এসব তথ্য জানান র্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।তিনি বলেন, তারা রেলস্টেশন থেকে বাসে করে কুমিল্লা ময়নামতি যায়। পথে তারা নিজেদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশে ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নিজেদের চুল কেটে ফেলে পশ্চিমা বেশভূষা ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস্, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। কিন্তু মোবাইল কিনলেও তারা সিম না কিনে ওয়াইফাই ব্যবহার করে।
ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, নিখোঁজের ঘটনায় ২ অক্টোবর রাতে নিখোঁজ শিক্ষার্থী দিলখুশ জান্নাত নিশার বড় বোন অ্যাডভোকেট কাজী রওশন দিল আফরোজ বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন। র্যাব-৪-এর গোয়েন্দা দল, গোপন তথ্যের সহায়তায় ও কক্সবাজারে থাকা র্যাব-৪-এর টিমের মাধ্যমে জানা যায়, নিখোঁজ তিন ছাত্রী মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) রাত ৯টার দিকে ছদ্মবেশে কক্সবাজার থেকে বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে রাওনা দেয়। এমন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৪-এর একটি আভিযানিক দল বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আবদুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে নিখোঁজদের উদ্ধার করে। প্রাথামিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি জানান, ওই তিন বান্ধবী মিরপুরের স্থানীয় কলেজে লেখাপড়া করত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে দিনদিন লেখাপড়ার প্রতি তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এর ফলে তাদের পরিবার পড়ালেখার জন্য ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার জন্য চাপ দিত। অতিরিক্ত পারিবারিক বিধিনিষেধের ফলে একটা সময় তারা পরিবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ে। তাদের নিজেদের পরিবারের নিয়মকানুন ভালো লাগত না। এসব সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চাভিলাসী জীবনযাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। তারা অধিক পরিমাণে জাপানি সিনেমা ও সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে জাপানি ভাষায় কিছুটা আয়ত্ব করে নেয়। এমনকি তারা দেশ ছেড়ে স্বাধীন জীবনযাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করার কারণ হিসেবে জাপানি সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার, স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ না থাকার কারণ উল্লেখ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস আগে তিন বান্ধবী তাদের বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়ী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামের এক নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়। ওই নারীর সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। পরে হাফসা চৌধুরী তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য ফেসবুকে বন্ধু হয়। তিন বান্ধবী হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার উদ্দেশে গত ৩০ সেপ্টেম্বর রিকশাযোগে প্রথমে গাবতলী যায়। হাফসার পরামর্শে পূর্ব পরিকল্পনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে সেজন্য তারা নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক আইডি ও ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলীতে নষ্ট করে ফেলে।
মোজাম্মেল হক আরো বলেন, পরবর্তীতে তারা নৌকাযোগে নদী পার হয়ে আমিন বাজার এলাকায় পৌঁছালে হাফসার দুজন লোক একটি কালো রঙের নোহা গাড়িতে করে অজ্ঞাত একটি জায়গায় নামিয়ে দিয়ে সিএনজিযোগে তাদের কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে রেলযোগে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তিন বান্ধবী তাদের কথামতো কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে চট্টগ্রামগামী কোনো রেল না পাওয়ায় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বাসে করে কুমিল্লা ময়নামতি যায়। পথে তারা নিজেদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশে ও পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নিজেদের চুল কেটে ফেলে পশ্চিমা বেশ-ভূষা ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস্, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। সেখান থেকে তারা পুনরায় বাসযোগে চট্টগ্রাম সিনেমা প্লেস বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দুটি মোবাইল কিনে বাসে করে কক্সবাজারে পৌঁছায়।র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল কিনলেও আত্মগোপনে থাকার জন্য তারা কোনো সিম কেনেনি। ১ অক্টোবর কক্সবাজার পোঁছে তারা ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজারের কলাতলির একটি হোটেলে অবস্থান করে। তারা সিমের পরিবর্তে ওয়াইফাই সংযোগ ব্যবহার করে। এরপর ২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার বিচ এলাকায় বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ ও শফিক নামের দুজন তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও কিছু নগদ টাকা নিয়ে নেয়। এ ঘটনায় তারা আতংকিত হয়ে হোটেল অবস্থান নেয় ও হোটেলের আশেপাশে র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে ছদ্মবেশে বাসে করে কক্সবাজার থেকে রওনা হয় ঢাকায়। রাজধানীর আব্দুল্লাহপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় পৌঁছালে র্যাব-৪-এর একটি দল তাদের উদ্ধার করে র্যাব-৪-এর কার্যালয়ে নিয়ে আসে। জনৈক হাফসাকে শনাক্তের বিষয়ে তিনি বলেন, হাফসার কোনো মোবাইল নম্বর অথবা কোনো তথ্য না থাকায় এখন পর্যন্ত তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে জনৈক হাফসাকে শনাক্ত, নোহা কার গাড়িতে থাকা দুজন ব্যক্তি ও কক্সবাজারের বীচ এলাকায় স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া দুই ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চিহ্নিত করে গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত আছে।