ফেনীতে আলোচিত স্বর্ণ ডাকাতির পরিকল্পনাকারীর দায় স্বীকার আদালতে

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ফেনী প্রতিনিধি,সোমবার, ১৬ আগস্ট ২০২ : ফেনীতে স্বর্ণ ডাকাতির পরিকল্পনাকারী ও আলোচিত মামলার বাদী চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সাবেক পার্টনার ছমদুল করিম ভুট্টুকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তারের পর সে রোববার (১৫ আগস্ট) রাতে ফেনীর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এর মধ্যেই মামলার আসামি ফেনীর ডিবির ওসিসহ ৬ পুলিশ কর্মকর্তা ও মামলার নথি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই দিন মামলার প্রধান আসামি ফেনীর ডিবির বরখাস্ত ওসির দ্বিতীয় দফা ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

রোববার (১৫ আগস্ট) গভীর রাত পর্যন্ত ফেনীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক কামরুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় ছমদুল করিম ভুট্টুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। পরে তাকে ফেনী জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।

এদিকে সন্ধ্যায় একই আদালতের বিচারক ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য মামলার প্রধান আসামি ফেনীর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) বরখাস্ত ওসি সাইফুল ইসলামের দ্বিতীয় দফা আরও ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে গত ১৩ আগস্ট শুক্রবার রাতে ফেনী মডেল থানা পুলিশের একটি দল চট্টগ্রামের হাজারী গলি থেকে ভুট্টুকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ জানায় ভুট্টো মামলার বাদী স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাসের সাবেক পার্টনার। তার বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থানার দক্ষিণ ধুরং গ্রামে। অন্যদিকে মামলার বাদী গোপাল কান্তির বাড়ি চকরিয়াতে। তারা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম নগরের হাজারী লেনের ইকুইটি কোহিনূর মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় ‘আলো জুয়েলার্স’ নামে একটি স্বর্ণের দোকান পরিচালনা করছেন। তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক বনিবনা না হওয়ায় বেশ কয়েক মাস আগে থেকে তারা পৃথক হয়ে যান। মূলত ব্যবসায়িক বিরোধের জেরেই ভুট্টু ফেনী জেলা ডিবি পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলামের যোগসাজশে তার দেওয়া তথ্য ও পরিকল্পনায় গত ৮ আগস্ট বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে ফেনী গোয়েন্দা পুলিশের ৬ কর্মকর্তা গোপাল কান্তি দাসের কাছ থেকে ২০টি বার ছিনতাই করেন। এই ২০টি স্বর্ণের বারের মোট ওজন ২ কেজি ৩৩০ গ্রাম। যার বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৬৩৬ টাকা।

এ ঘটনার দুই দিন পর ১০ আগস্ট ফেনী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহার হোসেন, নুরুল হক ও মিজানুর রহমান এবং এএসআই অভিজিৎ বড়ুয়া ও মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন ১১ আগস্ট তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস ফেনী মডেল থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, রোববার (৮ আগস্ট) বিকেল পৌনে ৪টার দিকে একটি প্রাইভেটকারে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০ পিস স্বর্ণের বার নিয়ে অলঙ্কার তৈরির জন্য ঢাকার তাঁতীবাজারের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। যাত্রাপথে বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ফেনী মডেল থানার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফতেহপুর রেলওয়ে ওভারব্রিজের সামনে পৌঁছালে ওয়্যারলেস ও পিস্তলসহ গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের জ্যাকেট পরা চারজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তার গাড়ি থামাতে সিগন্যাল দেয়। গাড়ি থামানোর পরই জ্যাকেট পরিহিত তিনজন গাড়ির ভেতরে ঢোকে। গাড়ির ভেতরে থাকা একজন পুলিশ ওই ব্যবসায়ীর মাথায় পিস্তল ধরে ও অন্য আরেকজন গাড়িচালক শওকতকে বেদম মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে তারা নিজেদের ফেনী ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তোদের কাছে অবৈধ মালামাল আছে, তাড়াতাড়ি বের কর।’

গোপাল কান্তি দাস জানান, গাড়িতে ওঠানোর পর ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা স্বর্ণের বারগুলো দেখতে চাইলে তাকে দেখানোমাত্র তিনি কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে বলেন, ‘তোর কাছে যতই বৈধ কাগজপত্র থাকুক না কেন এ মুহূর্তে তোকে ক্রসফায়ারে দেব অথবা ৫০০ থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা দিয়ে চালান দেব।’ তখন আমি ভয় পেয়ে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইলে তারা বলে, ‘স্বর্ণের বারগুলো তো পাবিই না, তোর এই গাড়ি, ড্রাইভার ও তোর নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য ১ কোটি টাকা দিতে হবে।’

চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী আরও জানান, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ফ্লাইওভারের নিচে রেলগেট সংলগ্ন নির্জন এলাকায় নিয়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে তারা। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে তারা আমাকে দিয়ে এটা বলতে বাধ্য করে যে, ‘আমার কাছে তারা ১২ পিস স্বর্ণের বার পেয়েছে যার বৈধ কাগজ দেখালে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়।’ একই সঙ্গে আমার দেওয়া বক্তব্য জোর করে ভিডিওধারণ করে এবং ঘটনাটি কারও কাছে প্রকাশ করলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।

ব্যবসায়ী গোপাল কান্তি দাস বলেন, গাড়িটি থামার পর তারা চোখ খুলে দিলে গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটি বারইয়ারহাট (মিরসরাই) দেখতে পাই। ওই সময় তারা আবারও আগের মতো জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিওধারণ করে। সবশেষে রাত প্রায় সোয়া ৮টার দিকে আমার গাড়িতে চালক শওকতকে তুলে দিয়ে সোজা বাড়ি ফিরে যেতে বলে। ওই সময় তারা বলে, ‘এখানে যা হয়েছে সব ভুলে যাও’। এ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় তারা।

গোপাল কান্তি দাস পরবর্তী সময়ে গাড়ি নিয়ে সোজা চট্টগ্রামে নিজ বাসায় ফেরেন। চট্টগ্রাম ফিরে স্বজন ও ব্যবসায়ীদের ঘটনা খুলে বলেন। চট্টগ্রাম স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পরামর্শে মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) ফেনী মডেল থানায় হাজির হয়ে বিষয়টি থানার ওসিকে মৌখিকভাবে জানান তিনি। তখন ওসি বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ওইদিন দুপুর ১টা ২০ মিনিটে পুলিশ লাইনে কর্মরত ডিবির কর্মকর্তাদের জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় হাজির করলে ডিবির ওসি মো. সাইফুল ইসলাম, এসআই মোতাহের হোসেন, এসআই নুরুল হক ও এএসআই মাসুদ রানাকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন ওই ব্যবসায়ী। তাদের রোববারের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা স্বর্ণের বার ছিনিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করে এবং বারগুলো ওসি ডিবির বাসায় রয়েছে বলে জানায়। পরে ওসি ডিবির বাসার আলমিরার ড্রয়ার থেকে ১৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

এদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ১৫ আগস্ট রোববার ফেনী মডেল থানা থেকে গ্রেপ্তারকৃত আসামি ডিবির ওসিরসহ ৬ কর্মকর্তা ও মামলার নথি ফেনীর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিকেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ফেনী পিআইবির পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন,  আদালতে রেকর্ডকৃত ভুট্টুর দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও রিমান্ড আসামিদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আমলে আনা হবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মামলার তদন্ত করা হবে। মামলার বাদির স্বর্ণের বৈধতাও খতিয়ে দেখা ছাড়াও বাকি ৫ স্বর্ণের বার উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

প্রসঙ্গত পিআইবির পরিদর্শক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহ আলম আলোচিত ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলার সফল তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদক ও পুলিশ পদকে ভূষিত হন।

উল্লেখ্য, প্রথম দফা ৩ দিনের রিমান্ড শেষে গত ১৪ আগস্ট শনিবার আসামি এসআই মোতাহার হোসেন, নুরুল হক ও মিজানুর রহমান এবং এএসআই অভিজিৎ বড়ুয়া ও মাসুদ রানার দ্বিতীয় দফা আরও ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। বর্তমানে স্বর্ণ ডাকাতি মামলার আসামি ডিবির ওসিরসহ ৬ কর্মকর্তাকে রিমান্ডে পিবিআইর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।