সেনা-পুলিশে নিয়োগের আগে ‘সতীত্ব’ পরীক্ষা যে দেশে!

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি,মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট ২০২১ : বিশ্বের অন্যতম বড় দ্বীপ দেশ ইন্দোনেশিয়া। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের চতুর্থ। পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গাও। কিন্তু জানেন কি এই দেশ আরও একটি কারণে বিশ্বের নজরে রয়েছে। সেখানে আজও ‘সতীত্বের পরীক্ষা’ দিতে হয় নারীদের!

গত পাঁচ দশক ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের ওপর এই নিয়ম চলে আসছে ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়ার নারীরা যদি পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান, তা হলে যোগ্যতা পরীক্ষায় তাদের প্রথমে ‘সতীত্বের প্রমাণ’ দিতে হয়!

‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নামে পরিচিত এই পরীক্ষা শুধু নারীদের মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত করে তোলে তাই নয়, অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক এই পদ্ধতিতে নারীদের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। অথচ পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গেলে পুরুষদের এমন কোনও প্রমাণ দিতে হয় না।
চিকিৎসক (পুরুষ এবং নারী নির্বিশেষে) নারীদের হাইমেন পর্দা সুরক্ষিত রয়েছে কি না পরীক্ষা করেন। পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের ফলে এই পর্দাটি ছিঁড়ে যায়। পর্দা ঠিকঠাক না থাকা মানেই ধরে নেওয়া হয় ওই নারী যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন। যদিও চিকিৎসকদের মতে, এই পর্দা আরও অনেক কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই পদক্ষেপ নারীদের ওপর ১৯৬৫ সাল থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই তখন থেকেই দেশের ভেতরে এবং বাইরে এ নিয়ে সরব হতে শুরু করেছিলেন নারীরা। নানা সময় এর সমালোচনা হয়েছে বিভিন্ন স্তরে।
আবার উল্টো দিকও রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার আবার এর ‘গুরুত্ব’ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বিশ্বকে। উচ্চপদস্থ অফিসারদের যুক্তি ছিল, একজন নারী যিনি সেনা হিসেবে দেশের সেবা করতে চান তাকে মানসিক এবং শারীরিক দিক থেকে অত্যন্ত দৃঢ় হতে হবে। তাদের দাবি, ‘সতীত্ব’ই নাকি কোনও নারীর দৃঢ় মানসিকতার পরিচয়।

১৯৯৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার মানবাধিকার কমিশন এই নিয়মকে বেআইনি ঘোষণা করে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কমিশন এই পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দাবি করে। কিন্তু এত কিছুর পরও চুপ ছিল ইন্দোনেশিয়া প্রশাসন।
২০১৪ সালে ইন্দোনেশিয়া পুলিশে নিয়োগের একটি বিজ্ঞপ্তি ফের ঝড় তোলে। তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, যোগ্যতা নির্ণায়ক পর্বে অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি নারীদের ‘সতীত্বের’ প্রমাণ দেওয়া বাধ্যতামূলক। তাতে এও লেখা ছিল, যেসব নারী নিজেদের পুলিশ হিসেবে দেখতে চান তারা যেন ছোট থেকেই ‘সতীত্ব’ বজায় রাখার মানসিকতা তৈরি করে নেন।
শুধু পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতেই নয়, ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার বেশকিছু স্কুলও ছাত্রী ভর্তির সময় এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দেয়।
এরপর ইন্দোনেশিয়ার চিকিৎসকরাও এর বিরুদ্ধে সরব হন। হাইমেন পর্দার পরিস্থিতি বৈজ্ঞানিকভাবে কখনও কোনও নারীর সতীত্বের প্রমাণ হতে পারে না বলৈ জানিয়ে দেন তারা।
কোনও নারীর হাইমেন পর্দা নানা কারণে ছিঁড়ে যেতে বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পর্দা ছেঁড়ার প্রকৃত কারণ বিশ্লেষণ না করেই ওই নারী কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছেন ধরে নেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল চিকিৎসক মহল।
২০১৫ সালে ইউরোপীয় কমিশন এই অভ্যাসকে ‘বৈষম্যমূলক এবং অবমাননাকর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন চিকিৎসক নিলা ময়লোয়েক। তিনিও সে সময় এই নিয়মের সমালোচনা করেন।
প্রকাশ্যেই তার মন্তব্য ছিল, ‘পুলিশ বা সেনাবাহিনীতে নারী নিয়োগে এই নিয়মের প্রয়োজনীয়তা, পদ্ধতি এবং ফলাফল নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।’
২০১৯ সালে পশ্চিম জাভার এক জিমন্যাস্টকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান গেমসে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি নাকি ‘সতীত্ব’ হারিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের এই ঘটনার পর চাপা অসন্তোষ ব্যাপক আকার ধারণ করতে শুরু করে ইন্দোনেশিয়ায়। আন্তর্জাতিক স্তর থেকেও এই অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার চাপ বাড়তে থাকে ইন্দোনেশিয়ার ওপর।
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে চুপ করে থাকা প্রশাসন এ বার নড়েচড়ে বসেছে। সম্প্রতি একটি ভিডিও বার্তায় এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার আভাস দিয়েছেন সে দেশের এক সেনাকর্তা।