ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি,সোমবার, ১৯ জুলাই ২০২১ : পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর মানসিক হাসপাতাটিতেই যেন গত সাত বছর ধরে নিজের বাড়িঘর হয়ে গেছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের চার সন্তানের জননী নুরুন্নাহারের। দিনমজুর স্বামীর কথা, পাড়ার মাদ্রাসার কথা কিংবা মেয়েদের কথা মনে পড়ে, গুমড়ে কাঁদেনও।
কিন্তু সাত বছর আগে যখন প্রথম মানসিক হাসপাতালের ঠিকানা হয়েছিল, তখন কেমন ছিলেন নুরুন্নাহার। তখন কী তার স্বামী, সন্তানদের কথা মনেই পড়েনি। মনে পড়েনি বাংলাদেশের কথা, মনে পড়েনি তার গ্রামের কথা, মসজিদ-বাজারের কথা; নুরুন্নাহারের মতোই গত পাঁচ বছর ধরে একই রকমভাবে সেখানে আছেন বরিশালের দুই সন্তানের জননী পারভীন বেগমেরও। তারও মনে পড়ে বাড়ির কথা, স্বামীর সঙ্গে সংসার ভাঙার কথা নিজের চাচা-চাচি, আদুরে চাচাতো বোনদের কথা। মনে পড়ে আর চোখের কোণে জল জমে, ভারি হয়ে ওঠে কণ্ঠস্বরও।
গল্প নয়, সত্যি। কলকাতা থেকে প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরের মুর্শিদাবাদ জেলা সদর বহরমপুর। সেখানেই এই মানসিক হাসপাতাল। সেখানেই রয়েছেন নুরুন্নাহার ও পারভীন। রয়েছেন আরও কয়েকজন বাংলাদেশি রোগী, যাদের অনেকেই এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু নাগরিকত্ব প্রমাণের অভাবে মানসিক হাসপাতালে প্রবল মানিসক যন্ত্রণায় ভুগছেন তারা। কে জানে দীর্ঘ কাউন্সিলিং, মিউজিক থেরাপি দিয়ে কষ্টকর প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে তাদের সুস্থ করে তোলার পর আবারও না তারা আগের মতো মানসিক ভারসাম্য হারান।
এমন সংশয় প্রকাশ করেছেন সরকারি হাসপাতালে নুরুন্নাহার-পারভীনদের সুস্থ করে তোলা বেসরকারি অঞ্জলী সংস্থার সংশ্লিষ্ট কমকর্তা স্বরুপ রায়। তার ভাষায়, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে তাদের ভালো করে তোলা হয়েছে। দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছেন তারা দুজন। ইমোতে ভিডিও কল করে দুজনের পরিবারের সাথেই যোগাযোগ হয়েছে; সরকারি উদ্যোগ শুরু হলেই দেশে ফিরতে পারবেন এই দুই সুস্থ হওয়া মানসিক বাংলাদেশি রোগী।
সময় টিভির কলকাতা ব্যুরোর উদ্যোগ
গত ১৪ জুলাই (বুধবার) দুপুর দুটো নাগাদ বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে এই দুই বাংলাদেশির সাথে কথা বলার সুযোগ হয়। বছর দুই আগে একই ভাবে মোরশেদা নামের বাংলাদেশি এক রোগীকে বাংলাদেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করেছিল সময় টেলিভিশন। পশ্চিমবঙ্গের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অঞ্জলী সময় টেলিভিশনের প্রতিনিধিদের মানসিক হাসপাতালে বাংলাদেশিদের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারের সুযোগ তৈরি করে দেয়।
সময় টেলিভিশনের ক্যামেরার দেখেই হু হু করে কেঁদে ওঠেন নুরুন্নাহার। বলেন, আমাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হাত জোর করে আকুতিও জানান তিনি। বলেন, আপনি তো অনেক কিছু করেছেন প্রধানমন্ত্রী, আমাদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করুন। আমার পরিবার হাতে তুলে দিন।
একইভাবে কণ্ঠস্বর ভারি করে আবেদন জানান পারভীনও। বলেন, আমরা ভালো নেই এখানে। খুব কষ্টে আছি। আমাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলেন নুরুন্নাহার
দিন তারিখ মনে করতে পারলেন না, তবে বছর সাতের আগের কথা। হঠাৎ মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তার। বাড়ির মানুষ বেঁধে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু রাতের অন্ধকারে পালালেন। ডাক্তার দেখাবেন ভেবে চট্টগ্রামের আমিরাবাদ থেকে ট্রেনে সিলেট পৌঁছান। সেখান থেকেই কিছু না বুঝে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়েন ভারতে। সেখানে ধরা পড়েন বিএসএফের কাছে। ভারতীয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রথমে তাকে আদালতে তোলে এবং যেহেতু তার মানসিক অসুস্থতা তাই তাকে পাঠানো হয় বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে।
আমিরাবাদের মোতালেব পাড়ার বাসিন্দা আবুল কাশের স্ত্রী নুরুন্নাহার। বড় মেয়ের নাম রোজিনা। এছাড়াও আরও তিন মেয়ে রয়েছে তার। স্বামী বাঁশের বেড়া বাঁধানোর কাজ করেন।
বাড়ির ঠিকানা বলতে গিয়ে জানালেন, তার বাড়ির পাশে দুটো মাদ্রাসা আছে। যথাক্রমে সুফিয়া মাদ্রাসা ও গোলাববাড়ি মাদ্রাসা। এমন কি এলাকার মেম্বারের নাম আজিজ মেম্বার বলেও জানালেন।
কী হয়েছিল পারভীনের সাথে
নুরুন্নাহারের সাথের ঘটনার কিছুটা মিল আছে পারভীনের। তবে পুরোটা নয়। দু’বছর মানসিক রোগে ভুগে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তবে তিন দিন বাড়িতে ফিরে চিকিৎসায় ভালো হয়ে ওঠেন। ডাক্তার দেখাবেন ভেবে এক পরিচিতের কাছে ভারতে আসবেন ভেবে সীমান্ত অতিক্রম করেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে। সেখান থেকেই তাকেও পাঠানো হয় এই মানসিক হাসপাতালে।
পারভীনেরও দুই সন্তান রয়েছে। তবে সেই সন্তানরা তার কাছে থাকতেন না। স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়ার কারণে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তাই স্বামীর চেয়েও তার আপন চাচা-চাচি ও ভাইবোনের দিকেই বেশি টান। বলছিলেন, বরিশালের বাবুগঞ্জের রহমতপুর গ্রামের বাসিন্দা তার চাচার নাম আলাউদ্দিন সর্দার। এলাকায় তাদের বাড়িকে সর্দার বাড়ি বলেই চেনে। তার চাচার মেয়েদের নাম কাকলী, সীমা, মোহনাদের তার খুব মনে পড়ে। খুবই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন যখন গ্রামের কথা, এলাকার কথা মনে হয় কেঁদে ওঠেন বার বার। প্রায় পাঁচ ধরে মানসিক হাসপাতালে ঠিকানা তারও। বাংলাদেশে কবে ফিরতে পারবেন সেটা নিয়েও রয়েছে তার গভীর অনিশ্চয়তা। বললেন, আমি হয়তো ভোট দিতে পারিনি। তাই সরকার আমাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করবে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি গিয়েই এবার ভোট হলে ভোট দেব। তাই সরকার আমাকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করুন।
অঞ্জলীর ভূমিকা কী
মূলত এই সংস্থা একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে রোগীদের বিভিন্নভাবে সুস্থ করে তোলার কাজ করেন এই সংস্থার কর্মীরা। কাউন্সিলিং, যোগ, মিউজিক থেরাপি এবং নিয়মিত হাতের কাজ কিংবা মানসিক বিকাশ ঘটে এমন কাজ করান রোগীদের দিয়ে। সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায়। তারই গড়া প্রতিষ্ঠান এখন পশ্চিমবঙ্গে মানসিক হাসপাতালগুলোতে রোগীদের সুস্থ করার কাজ করছেন। সেখানে রয়েছেন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে অন্যতম স্বরুপ রায়।
কীভাবে ফিরতে পারবেন তারা
প্রথমত তারা যে বাংলাদেশি নাগরিক সেটা আগে মৌখিকভাবে নিশ্চিত হতে হবে। এরপর তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে নাগরিকত্বের প্রমাণ সংগ্রহ করে জানাতে হবে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। তারাই চিঠি পাঠাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। সেখান থেকে কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরাষ্ট্র দপ্তরে পাঠাবে চিঠি।
বাংলাদেশের পরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে ডিবির মাধ্যমে নাগরিকত্ব নিশ্চিত করবে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদন আবার ওই একই মাধ্যমে ফিরবে ভারতে। এবার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন থেকে তৈরি হবে বহির্গমন পাস। সেটা হলে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সময় নির্ধারণ হলে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে তাদের পরিবারের হাতে কিংবা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হাতের তুলে দেওয়া হবে এই সুস্থ হওয়া রোগীদের।