ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,২৬ এপ্রিল : হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। এখন এসব তথ্যের যাচাই-বাছাই চলছে জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. হারুন-অর-রশীদ বলেছেন, পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক দলকে মডেল হিসেবে নিয়েছিলেন মামুনুল হক। একই সঙ্গে পাকিস্তানের একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল তার। ভগ্নিপতি নেয়ামত উল্লাহর মাধ্যমে সেই জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি। আর এই নেয়ামতের সঙ্গে ২০০৫ সালের দিকে মামুনুল টানা ৪৫ দিন পাকিস্তানে অবস্থান করেন। গতকাল বিকালে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ডিসি হারুন।
মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে থাকা মামুনুলের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে দাবি করে তিনি বলেন, নেয়ামত উল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি মাওলানা তাজউদ্দীনের। মুসলমানদের ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার পাশাপাশি ভারতবিদ্বেষী মনোভাব উসকে দিতে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় বাবরী মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন মামুনুল। মসজিদ নির্মাণের নামে দুবাই, কাতার, সৌদিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে মামুনুল হকের বিকাশ এবং বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকা আসত। বিশেষ করে ভারতবিদ্বেষীরা এই টাকা দিয়েছেন। এ টাকা দিয়ে তিনি উগ্রবাদী কায়দায় বাংলাদেশের কয়েকটি মসজিদের ও মাদরাসার কিছু লোককে ম্যানেজ করেছেন এবং নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তাকে যেন বিভিন্ন জায়গায় ওয়াজের জন্য ডাকা হয় সে ব্যবস্থা করেছেন।
ডিসি হারুন বলেন, মামুনুল হকের আপন ভগ্নিপতি মুফতি নেয়ামত উল্লাহ দীর্ঘদিন পাকিস্তানে থাকার পর দেশে ফেরেন। এরপর তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসায় যোগ দেন। পরে মাওলানা তাজউদ্দীন দেশে ফিরে জামিয়া রাহমানিয়া মাদরাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মুফতি নেয়ামত উল্লাহ আটক হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের হস্তক্ষেপে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সরকার উৎখাতে মামুনুল সব ধরনের পরিকল্পনার বিষয়ে হারুন-অর-রশীদ বলেন, পাকিস্তানের একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনকে মডেল ধরে বাংলাদেশে মওদুদি, সালাফি, হানাফির মতাদর্শের মানুষকে একত্র করেন তারা। ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ধর্মের নামে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে হেফাজতে ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নাশকতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসাত্মক কাজের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন মামুনুল। উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক পদ, পদবি ও ক্ষমতা দখল করা। মামুনুল হকের আপন ভায়রা ফরিদপুরের টেকেরহাটের জামায়াত নেতা। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বলেন, ‘‘গ্রেফতার হওয়ার আগে মামুনুল সংসদ ভবন, গণভবন, বঙ্গভবন, বড় বড় আলেম-ওলামা, এমপি-মন্ত্রী কাউকেই তোয়াক্কা করতেন না। আমরা মামুনুলকে বললাম, ‘আপনি জাফর ইকবালকে কট‚ক্তি করলেন, শাহরিয়ার কবিরকে মুরগিচোরা বললেন, আপনার দিকে কেউ তাকালে চোখ তুলে ফেলবেন- এগুলো কেন বললেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘এগুলো রাজনৈতিক কথাবার্তা। বক্তব্য দেওয়ার সময় চলে এসেছে।’ ‘প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কেউ কট‚ক্তি করলে সে ১২ ঘণ্টার মধ্যে গুম হয়ে যায়’- এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জানতে চাওয়া হয়, ‘কে এমন গুম হয়েছে?’ তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, তার প্রথম স্ত্রীর বাবা (শ্বশুর) ও বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম ছিলেন ভায়রা। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’’ একই মামলার আসামি তার ভাই মাওলানা মাহফুজুল হককে গ্রেফতার না করা প্রসঙ্গে ডিসি হারুন বলেন, ‘তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় গিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই। আমরা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেছি, এ মামলায় যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
মামুনুল হকের যত হুমকি : দেশের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিল এবং সমাবেশের বক্তৃতায় হুঙ্কার দিয়েছেন মাওলানা মামুনুল হক। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করে একটি ওয়াজ মাহফিলে সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘যদি মূর্তি নির্মাণ করেন, তবে আপনি আবু জাহেলের প্রেতাত্মা।’
২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে সেই ভয়াল রাতে মামুনুল হক বলেছিলেন, ‘লাশের পর লাশ পড়বে, রক্তের বন্যা বইবে, সৈয়দ আশরাফ সাহেব কী করবেন। পরিষ্কার ঘোষণা করতাছি, আজ রাতের পর আপনারা কোন পথে পালাবেন সেই পথ দেখার চেষ্টা করেন।’ ২০১৩ সালের পর একটি মাহফিলে মামুনুল বলেন, ‘শাহাদাতের রক্ত দিতে যদি আবার শাপলা চত্বরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তবে আমার শাপলা চত্বরে যাব।’ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মামুনুল হকের বক্তব্য ছিল, ‘কেন্দ্র দখল করে ভোট ডাকাতি করে অবৈধভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ছিনতাই করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছেন।’ একটি ওয়াজ মাহফিলে রাশেদ খান মেনন, শাহরিয়ার কবির এবং বিচারপতি মানিককে পেটানোর হুমকি দিয়ে ঔদ্ধত্যের সুরে মামুনুল হক বলেন, ‘রাশেদ খান মেনন, মুরগিচোরা শাহরিয়ার কবির, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মানিক সাহেব এই তিনজনকে বাংলার যে কোনো জায়গায় পাওয়া যাবে, সঙ্গে সঙ্গে জুতা খুলে পেটাইতে হবে।’ মেননকে গোটা বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন তিনি। মামুনুল হক বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে যদি কেউ কটাক্ষ করে, ১২ ঘণ্টা লাগে না সে গুম হয়ে যায়। আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায় না। বুকের রক্তের গঙ্গা প্রবাহিত হতে পারে। বঙ্গভবন, সংসদ ভবন, গণভবন সব ভেসে যাবে বঙ্গোপসাগরে।’ বায়তুল মোকাররমের সামনে সম্প্রতি মামুনুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, আপনার মন্ত্রীদের সামলান। গাঁজাখোর হানিফকে সামলান, আইনমন্ত্রীকে সামলান, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুসহ নাস্তিক-মুরতাদদের সামলান। যদি সামলাতে না পারেন, বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। তারা পিঠের চামড়া খুঁজে পাবে না।’ অন্যত্র এক ওয়াজ মাহফিলে তিনি হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ‘আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকালে সেই চোখ উপড়ে ফেলা হবে। কলকাতার দাদাবাবুদের ঠেঙায়ে বিদায় করেছি। নতুন করে আমার এ দেশের আলেম সমাজকে পাকিস্তানি গালি শুনবার জন্য নয়। গোটা বাংলাদেশের কওমি মাদরাসায় বিদ্রোহের আগুন ধরবে।’ সেই চোখ উপড়ে ফেলার মতো হিম্মত আছে কি না, সমাবেশে আগতদের কাছে জানতে চান মামুনুল। পরে তিনি নিজেই বলেন, ‘সাগর পরিমাণ রক্ত দিতে আমরা প্রস্তুত। জীবন দিতে আমরা প্রস্তুত।’ মামুনুল হক বলেছেন, ‘মন্ত্রী সাহেব, জাতির সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলতে হয় আপনার বাবা শিক্ষা দেই নাই। ঘাড় মটকে দেবেন কার? মন্ত্রিত্বের চেয়ারে বসেছেন, এই চেয়ার আপনার বাপ-দাদার কেনা সম্পদ নয়। হুমকি তো দূরের কথা, বুলেটের বৃষ্টি মুখে ইমানের জিম্মাদারি পালন থেকে একচুল পরিমাণ পিছপা হওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।’
মামুনুলের বিরুদ্ধে আরও দুই মামলা : হেফাজত ইসলামের আন্দোলনে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে মোটরসাইকেল পোড়ানোর দায়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা করা হয়েছে। গতকাল বিকালে আবাব আহমেদ রজবী ও মো. রুমান শেখ নামে দুই ব্যক্তি পল্টন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা দুটি করেন। সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পল্টন মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, তারা মামলায় অভিযোগ করেন, গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররমের সামনে আন্দোলনের নামে হেফাজতে ইসলামের লোকজন তাদের দুজনের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। আন্দোলনের নির্দেশদাতা হিসেবে মাওলানা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দুটি করেছেন তারা। এই মামলায় হেফাজতের আরও তিন নেতাকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- সংঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা লোকমান হাকিম, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও নাছির উদ্দিন মনির। তাদের বিরুদ্ধেও মামলায় অভিযোগ আনা হয়।