তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধ : মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়,২৬ ডিসেম্বর : মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া, এমপি : কুমিড়ার যুদ্ধের পর আমি কালুরঘাটস্থ বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে  সম্পৃক্ত হই। ৩০ মার্চ  বেতার কেন্দ্রটি পাকবাহিনীর হাতে ধ্বংসের পর আমি রামগড় দিয়ে সার্বরুম হয়ে আগরতলায় পৌঁছি। সেখানে ৩নং সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেই। তেলিয়াপাড়ার লড়াই তেমনি একটি অধ্যায়। পাঠকদের সেই লড়াইয়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরছি।
২৫ এপ্রিল, ১৯৭১ আমি তখন সিলেটের তেলিয়াপাড়ায়। তেলিয়াপাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের মধ্যে রেল ও সড়ক পথে সংযোগ স্থল। ২৭ এপ্রিল আমি তেলিয়াপাড়ায় নতুন করে দায়িত্ব নেই। সেখানে আমি ও ক্যাপ্টেন মতিন যৌথভাবে কাজ করি। আমাদের অধীনে প্রায় ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ইষ্ট বেঙ্গল রেজিস্ট্রার ইপিআর। এ-ছাড়াও কিছু সংখ্যক ছিল মুজাহিদ বাহিনীর। তেলিয়াপাড়ায় শত্রু বাহিনীর সাথে আমাদের তুমুল লড়াই হয়।
আমরা তেলিয়াপাড়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়ার প্রথম দিনেই শত্রুরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং এই লড়াইয়ের পর তেলিয়াপাড়া দখল করে নেয়। এই আক্রমণটা ছিল অত্যন্ত আকস্মিক। যুদ্ধের ‘ট্যাকনিক্যাল’ দিকটা বিচার করলে, আক্রমণের সময় যে বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হয় তাদের মধ্যে একটি হলো অতর্কিতে আক্রমণ। এই অতর্কিত আক্রমণের কারণেই আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। কিন্তু শত্রুরা তেলিয়াপাড়া দখল করার পর মুহূর্তেই আমরা খুব অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাই এবং হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই। তেলিয়াপাড়া থেকে যখন আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই, তখন আমাদের জওয়ানরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু এই ছত্রভঙ্গ অবস্থায়ই আমরা যখন পাল্টা আক্রমণ চালাই, শত্রু তখন পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাল্টা আক্রমণের সময় মেজর মতিনের সাথে যে দলটি ছিল তারা উচ্চ স্বওে শ্লোগান ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ফায়ার করতে করতে অগ্রসর হওয়ার সময় শত্রুবাহিনী অনেকটা ঘাবড়ে যায়। যদিও জওয়ানদের কম ছিল, তবুও শ্লোগনের আওয়াজে মনে হচ্ছিল যেন আমরা সংখ্যায় অনেক। এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না, পাল্টা আক্রমণের সময় আমরা মর্টারের সাহায্য নিয়েছিলাম। মর্টার ছিল মাত্র একটা, কিন্তু তাতে আবার সাইট ছিল না। বিনা সাইটে মর্টারের গোলা যেভাবে কার্যকরী হয়েছিল তা সত্যিই ভুলবার নয়। সাইট না থাকায় আমাকে অনেকটা আন্দাজের ওপরই গোলা নিক্ষেপ করার আদেশ দিতে হয়েছিল। শত্রুবাহিনী তেলিয়াপাড়া দখল করার পর যেখানে একত্রিত হয়েছিল, ঠিক সেখানেই গোলাগুলো পড়ে। গোলা এত সঠিকভাবে শত্রু বাহিনীর ওপর পড়বে, এ ছিল আমাদের কল্পনারও বাইরে।
তেলিয়াপাড়া পুনরুদ্ধারের পর শত্রুবাহিনী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এমন কি সে সময় তারা আমাদের ওপর দিনে দু’বার আক্রমণ করে। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের জওয়ানরা শত্রুবাহিনীর আক্রমণের পাল্টা জবাব দেয়। কয়েকদিন লড়াই চলার পর আরো কিছু সংখ্যক লোক পাঠিয়ে আমাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি করা হয়।
তেলিয়াপাড়ায় অবস্থানকালে আমাদের নানা অসুবিধার ভিতর দিন কাটছিলো। খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এক নাগারে পাঁচ দিনের মতো আমরা ঠিকমতো কোনো খাবারই পাইনি। তাছাড়া খাবার যাও পাওয়া যেত, তবে তা কখনো নিশ্চিন্তে খাওয়ার উপায় ছিল না। শত্রু পক্ষ ঠিক খাওয়ার সময় আমাদের ওপর কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করতো। কোন কোন দিন ঠিক খাওয়ার সময়ই আমাদের ওপর আক্রমণ চালানো হতো। এ অবস্থায় আমরা কাঁচা কাঁঠাল এবং আধাপাকা র্লিচু খেয়েই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেই। সে সময় কয়েকদিন প্রবল বৃষ্টিও হয়েছিল। বৃষ্টির পানিতে আমাদের ট্রেঞ্চগুলো ভরাট হয়ে যায়। রাতে শত্রুর আক্রমণের সময় সেই সব পানি ভর্তি পরিখায় অবস্থান নিয়েই আমাদেরকে তাদের মোকাবেলা করতে হত। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এক সময় আমি এবং আমার রানার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পানি ভর্তি পরিখায় ছিলাম। আমাদের হাতে ঐ সময় কোন ম্যাপ ছিল না। ছিল না কোন দূরবীণ, কম্পাস। বলতে গেলে আমাদের হাতে তখন থ্রি নট থ্রি রাইফেল এবং কতগুলো এলএমজি ছাড়া আর কিছু না। অবশ্য দুটো মর্টার ছিল যার কোনো সাইট ছিল না। এ সময়ে শত্রুরা রাতদিন কামান থেকে গোলাবষর্ণ করত। এই শেলিংয়ের কারণে আমাদের কয়েকজন সৈনিক ঐ সময়ে শাহাদাৎবরণ করে। একদিন শত্রু পক্ষের একটি আর্টিলারী শেল এসে তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাক বাংলোর সামনে পড়ে। তাতে বটগাছের নিচে অবস্থানরত আমাদের ৫ জন ছাত্র শহীদ হয় এবং ঐখানেই সেই পাঁচজন বীর তরুণকে সমাহিত করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে আমার এবং ক্যাপ্টেন মতিনের মধ্যে তখন প্রায়ই যোগাযোগ থাকত না। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বেতার যোগাযোগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বেতার যোগাযোগ দ্বারা যুদ্ধক্ষেত্রে কমান্ড এবং কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই প্রচণ্ড লড়াইয়ের ভিতর কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় মনে হতো সবাই যেন পজিশন ছেড়ে চলে গেছে, কখনও কখনও মনে হয় আমি একাই যেন সেখানে পজিশন নিয়ে আছি। সেই প্রচ- গোলাগুলির মধ্যে আদৌ বোঝা সম্ভব ছিল না কে কোথায় মৃত্যুর সাথে লড়ে যাচ্ছে। একমাত্র সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করে নিজের অবস্থানে বসে থাকতাম। প্রাণপণে মোকাবেলা করে যেতাম শত্রুকে। আমাদের সাথে যে সব ইপিআর, মুজাহিদ ও ছাত্র সংগ্রামীরা ছিল তারা সবাই শত্রুর বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে মুজাহিদ দুলা মিয়া, যে সাহস ও মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে লড়াই করেছিল তাঁর কথা আজও মনে পড়ে।
কুমিল্লার সালদা নদীর কাছে দুলা মিয়ার বাড়ি। লড়াইয়ে তাঁর অসীম সাহস দেখে ক্যাপ্টেন মতিন তাকে একটা সেকশনের নেতৃত্বের ভার দেন। বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্য এই অকুতোভয় দুলা মিয়া এবং আরেকজন দুঃসাহসী ছেলে (তার নাম এখন মনে পড়ছে না) মেজর সফিউল্লাহর কাছ থেকে ২৫ টাকা করে পুরস্কার পেয়েছিল। দুঃসাহসী মুজাহিদ দুলা মিয়া পরে সিলেটের মুকুন্দপুরের লড়াইয়ে শত্রুর হালকা মেশিনগানের গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন। কয়েকটি গুলি তার পেটে এসে লাগে। কিন্তু আহত হওয়া সত্ত্বেও দুলা মিয়া তার জায়গা ছেড়ে পিছু হটেনি। একইভাবে সে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। মারাত্মক আহত অবস্থায় পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
তেলিয়াপাড়ায় লড়াই করার সময় খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধার কথা আগেই বলেছি। এ সময়ে জোয়ানরা  ঠিকমত খাওয়া পেত না। লড়াইয়ে ৬ষ্ঠ দিনে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর একটি জওয়ান এসে জানালো তার গায়ে জ্বর, তার শরীর কাঁপছে এবং গত পাঁচদিন ধরে সে কোন খাবার পায় নি। হাতের রাইফেল মাটিতে রেখে দিয়ে সে হতাশার সুরে বলে, খাওয়া ছাড়া কিভাবে লড়াই করি। আমার দ্বারা আর লড়াই করা সম্ভব না।
ক্যাপ্টেন মতিনকে লক্ষ্য করেই সে কথাগুলো বলে। জবাবে ক্যাপ্টেন মতিন শান্ত কণ্ঠে বলেন, দেখ খাবার আমরাও পাইনি, কিন্তু তাই বলে লড়াইতো আর বন্ধ রাখা যায় না। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে খাবার না পেলেও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
ক্যাপ্টেন মতিনের কথায় ছেলেটি অভিমানে রেগে উঠে বলে, স্যার যদি খাবার না দেন তাহলে লড়াই করতে পারবো না। এই নিন আমার রাইফেল।
লড়াইয়ের ডিসিপ্লিন-এর স্বার্থে ক্যাপ্টেন মতিনকে কঠোর হতে হলো। সে ছেলেটিকে সঙ্গে সঙ্গে এরেস্ট করে। তাকে একটি কাঁঠাল গাছের সাথে সাথে রশি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধেন।
তারপর বলেন, এরপর যদি কেউ খাবারের জন্য আসে তাহলে তাকে তুমি একথা বলবে যে খাবারের জন্য যেও না, খাবার চাইতে গেলে আমার মতো অবস্থা হবে।
তখন ছেলেটির পাশ দিয়ে যে কেউ যাচ্ছিল ছেলেটি তাদের ঐ কথাগুলোই বলতো।
প্রায় তিন ঘণ্টা ছেলেটিকে এমনিভাবে গাছের সাথে বেঁধে রাখার পর আমি ক্যাপ্টেন মতিনকে বলে তাকে ছাড়িয়ে দেই। তবে লড়াইয়ের বৃহত্তর স্বার্থে এবং নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের কঠোর হতে হয়েছিল।
তেলিয়াপাড়ায় থাকাকালীন আমাদের হেডকোয়ার্টারটা ছিল সীমান্তে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত। প্রায় এক নাগারে ৬ দিন লড়াই করার পর ক্যাপ্টেন মতিন এবং আমাকে সৈন্যসহ হেডকোয়ার্টারে উঠিয়ে নেয়া হলো। আমাদের জায়গায় তেলিয়াপাড়ায় এলেন লেঃ মোরশেদ এবং তার সৈন্যদল। এরা ছিলো ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য। লেঃ মোরশেদের সৈন্যদের সঙ্গে তেলিয়াপাড়াতে শত্রু বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। তেলিয়াপাড়ায় থাকাকালীন লেঃ মোরশেদ কয়েকটি চমৎকার এ্যাম্বুশ করেন। শুধু একটি এ্যাম্বুশেই সে পাতা মাইনের সাহায্যে দু’ট্রাক ভর্তি শত্রু সৈন্য নিহত হয়, আহতও হয় প্রচুর। লেঃ মোরশেদ সেখানে কিছুদিন ছিল। পরে সেখানে মেজর সফিউল্লাহর নির্দেশে আমি পুনরায় তার স্থলাভিষিক্ত হই।
এ সময়কার একটি মজার ঘটনা বলি।
লেঃ মোরশেদের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর সকাল আটটায় ডিফেন্স পজিশন অর্থাৎ প্রতিরক্ষা অবস্থান পরিদর্শন করতে শুরু করি। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কয়েকজন জওয়ান যারা আমার অধীনে চাকুরী করত, তাদের কয়েকজন সে সময়ে লেঃ মোরশেদের অধীনে যোগ দিয়েছিল। প্রতিরক্ষা অবস্থান চেক করতে গিয়ে এলএমজি পজিশনের কাছে ওদের কয়েকজন সিপাইয়ের সাথে আমার প্রায় দশ মিনিট ধরে আলাপ হয়। জোয়ানদের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তখন তাদেরকে নানাভাবে উৎসাহিত করে তুলছিলাম।
তারপর জোয়ানদের সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে খোঁজ নিলাম। তখন আলাপ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামে আমার অধীনে যারা চাকুরী করেছিল তাদের মধ্যে একজন আমাকে প্রশ্ন করলো, স্যার, চট্টগ্রামে আমাদের কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া, তাঁর খবর কি? তিনি কি বেঁচে আছেন? আমরা শুনেছি তিনি নাকি চট্টগ্রামের লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন।
তার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম ছেলেটার মাথা খারাপ নাকি। সে আমার অধীনে চাকরি করেছে অথচ আজ আমাকেই চিনতে পারছে না।
যা হোক, উত্তর তাকে বললাম, তুমি আস্ত বোকা। কিন্তু উত্তর সন্তোষজনক না হওয়াতে সে আবারও প্রশ্ন করল, সত্যি স্যার, বলুন না, ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার খবর কি? তিনি কি বেঁচে নেই?
হেসে বলি এতক্ষণ তুমি ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার সাথেই কথা বলছো।
আমার জবাব শুনে সে বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যায়। গভীর দৃষ্টিতে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, স্যার, আপনি একেবারে বদলে গেছেন।
সত্যি বদলে যাবার কথা। সে সময়ে আমার মাথায় চুল ছিল না। তাই সব সময়ই মাথায় ক্যাপ পরে থাকতাম। আমাকে চিনতে না পারার এর চেয়েও বড় কারণ, আমার তখন মুখ ভর্তি দাড়ি। পরনে একটা ছেড়া শার্ট ও লুঙ্গি। পা একেবারেই খালি। অতএব এ অবস্থায় আমাকে চিনতে আরও কঠিন ছিল বৈকি।
আমাদের যে সব সংগ্রামী তরুণ তেলিয়াপাড়ার লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে তারা কখনো তেলিয়াপাড়ার কথা ভুলতে পারবে না। কারণ তেলিয়াপাড়াতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্টের ভিতর দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। এই লড়াইয়ে পাকিস্তান বাহিনীর ক্ষতিও হয় প্রচুর। একদিনের লড়াইয়ে আমরা একটা সাতটনী ট্রাক দখল করি। শত্রুবাহিনী তেলিয়াপাড়ায় আমাদের সাথে প্রাণপণে লড়াই করে। সতেরো দিন প্রাণপণে যুদ্ধের পর শত্রুবাহিনী আমাদেরকে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ করে। শত্রুর এই ত্রিমুখী আক্রমণের ফলে আমাদেরকে বাধ্য হয়ে তেলিয়াপাড়া ত্যাগ করতে হয়।
তবুও এই সতেরো দিন মাটি কামড়ে পড়ে থাকায় বিরল কিছু অভিজ্ঞতা হয়। শত্রুর মেশিনগানের বিরুদ্ধে থ্রি নট থ্রি দিয়েও লড়াই চালিয়ে যাওয়া যায় যদি মনোবল থাকে। অনাহার, অন্ধকার, বৃষ্টি, শীতও হার মানে মানুষের দেশপ্রেমের কাছে। আমরা সৈনিক বলেই যে কোন প্রতিকূল অবস্থার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ, কৃষক, ছাত্র- এদের অসীম দেশপ্রেমের কোনো তুলনা ছিল না। বিশেষ করে ওয়াকার আর সাদেক। দু’জনই তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র। পরে অবশ্য দু’জনই সেনাবাহিনীতে কমিশন পায়। এই ওয়াকার আর সাদেক শত্রুর মনে ভীতিসঞ্চার করার জন্য গোটা দশেক থ্রি নট থ্রি রাইফেল এক জায়গায় জড়ো করে ওয়ান টু থ্র্রি বলে এক সাথে ফায়ার করত বাজ পড়া শব্দের মতো সেই বিকট আওয়াজ নির্ঘাৎ শত্রুর বুকও কাঁপিয়ে দিত। তাই তেলিয়াপাড়া যুদ্ধের সেই দিনগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ওখানে যুদ্ধরত অবস্থায় আমরা নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি যা অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে দক্ষ সৈনিকে রূপান্তর করতে সাহায্য করে।

লেখক  : সংসদ সদস্য এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি