ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ষ্টাফ রিপোর্টার,১৮ অক্টোবর : বদলির আবেদনে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের জাল-জালিয়াতি ও দুর্নীতিবাজদের নাম-পরিচয় ফাঁস করে দেয়ায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অথচ বহাল তবিয়তে আছেন অভিযুক্তরা। তদন্ত কমিটি গঠন তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অবিশ্বাস্য হলেও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রি অফিসের এক তদন্ত প্রক্রিয়ায়। সোমবার জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠিতে এমন সিদ্ধান্তের কথা ভুক্তভোগী নারী কর্মচারী লায়লা আক্তার তুলিকে অবহিত করা হয়। বিভাগীয় মামলায় দ্বিতীয় কারণ দর্শানো এ নোটিশে বলা হয়েছে, তাকে চাকরি হতে বরখাস্ত করার গুরুদণ্ড কেন আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে হবে।
বিভাগীয় মামলার ৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনসহ অফিস সহকারী লায়লা আক্তার তুলির লেখা বদলি আবেদনটিও যুগান্তরের হাতে এসেছে। বদলি আবেদনে তুলি উল্লেখ করেন, ‘২৭.১০.১৯ তারিখে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে তিনি যোগদান করেন। এর আগে অফিস সহকারী হিসেবে ঢাকা জেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সুনামের সঙ্গে চাকরি করেছেন। কিন্তু কেরানীগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যোগ দেয়ার পর থেকে তিনি দেখতে পান, কিছু বহিরাগত দলিল লেখক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই দলিল দাখিল করছেন। বিষয়টি তিনি সাবরেজিস্ট্রারকে অবহিত করলে উল্টো সাবরেজিস্ট্রার মৃত্যুঞ্জয় শিকারি তাকে চুপ থাকতে বলেন। এছাড়া জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহারের উদ্ধৃতি দিয়ে তাকে অফিসের মৌলিক কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। তিনি দরখাস্তের এক স্থানে উল্লেখ করেন, অফিসের উমেদার লিয়াকতের মাধ্যমে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। লিয়াকত অবৈধ সুবিধা নিয়ে ভুয়া কাগজ দিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি করার জন্য সাবরেজিস্ট্রার স্যারকে বাধ্য করে। কিন্তু এ অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বাধা দেয়ার কারণে অজ্ঞাত ফোন নম্বর থেকে তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।’ আবেদনে আরও বলা হয়, ‘আমাদের সাবরেজিস্ট্রার স্যার অজ্ঞাত কারণে উমেদারকে ভয় পান। কিছু বলেন না। উমেদার লিয়াকত আমাকে এ অফিস থেকে তাড়ানোর জন্য পাঁয়তারা করছেন। দলিল লেখকদের দলিল আটকিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করানো হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কাছে ফোন কল রেকর্ড আছে।’ এ অবস্থায় তার আশঙ্কা, এখান থেকে দ্রুত বদলি না হলে ষড়যন্ত্রকারী দুর্নীতিবাজরা তাকে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। নিবন্ধন পরিদফতরের মহাপরিদর্শক বরাবর লেখা এ আবেদনের অনুলিপি তিনি আইনমন্ত্রীকেও দেন।
দলিল লেখকদের ভুয়া অভিযোগের সূত্র ধরে অফিস সহকারী তুলির বিরুদ্ধে তড়িঘড়ি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যা ছিল উদ্দেশ্যমূলক। কেরানীগঞ্জ দক্ষিণের সাবরেজিস্ট্রার মৃত্যুঞ্জয় শিকারি ১৯ ফেব্রুয়ারি তদন্ত করে অফিস সহকারী লায়লা আক্তার তুলিকে দোষী সাব্যস্ত করেন। এর ওপর ভিত্তি করে দ্রুত বিভাগীয় মামলা করে ১২ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে গুলশান সাবরেজিস্ট্রার মোহাম্মদ রমজান খানকে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু এ কর্মকর্তার ওপর অনাস্থা দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের জন্য বিবাদী আবেদন করলেও সেটি আমলে নেয়া হয়নি। এভাবে দ্রুত বিভাগীয় মামলার তদন্ত শেষ করে ১৭ আগস্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা রেজিস্ট্রারের দফতরে রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু বিতর্কিত এ প্রতিবেদন সাবরেজিস্ট্রারদের নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা থেকে সেটি প্রায় ১ মাস আটকে রেখে নির্বাচন শেষে ১২ অক্টোবর রিলিজ করা হয়। এ সংক্রান্ত চিঠিতে অসদাচরণের দায়ে তাকে চাকরিচ্যুত করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানিয়ে দেয়া হয়।
বিভাগীয় মামলার প্রতিবেদনে মূল বক্তব্য হিসেবে বলা হয়, দলিল আটকে রেখে অর্থ আদায়ের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তবে বদলির জন্য তিনি ৮ মার্চ যে আবেদন করেছেন সেখানে বর্ণিত কিছু বক্তব্য/ব্যবহৃত শব্দাবলি একজন সরকারি কর্মচারীর বদলি আবেদনে উল্লেখ করা শোভনীয় নয়। তাই সার্বিক বিবেচনায় তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ এর বিধি ৩(খ) অনুযায়ী অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার তার চিঠিতে মূল বক্তব্যে হিসেবে বলেন, কেন তাকে গুরুদণ্ড হিসেবে চাকরি হতে বরখাস্ত করা হবে না তার কারণ জানাতে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী অফিস সহকারী লায়লা আক্তার তুলি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। ভুয়া অভিযোগপত্র প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় এখন বদলি আবেদনে উমেদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা বলায় তাকে গুরুদণ্ড দেয়া হবে। এটা অন্যায় এবং বেআইনি। আমি ন্যায়বিচারের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বদলি আবেদন আমি পরিবর্তন করিনি। আমার স্বাক্ষর জাল করে সাব-রেজিস্ট্রার এ অপচেষ্টা চালিয়েছেন। আমার কাছে এর প্রমাণ আছে। তিনি জানান, বিভাগীয় মামলার তদন্তের সময় তাদের মতো করে বক্তব্য লিখে আমার স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। আমাকে ওই কাগজপত্র পড়তে দেয়া হয়নি। নিয়মানুযায়ী লিখিত বক্তব্য নেয়ার কথা থাকলেও সেটিও নেয়নি। তিনি আরও বলেন, জেলা রেজিস্ট্রারের দফতরে আমার কোনো আবেদন রিসিভ করা হয়নি। অন্তত ১০টি আবেদন দিয়েছি। কিন্তু প্রধান অফিস সহকারী হালিমা আক্তার কোনো চিঠি রিসিভ করেননি। মূলত অসদুদ্দেশ্যে ডিআর অফিসের হালিমা ও কম্পিউটার অপারেটর শরিফ চক্রান্তকারী সিন্ডিকেটের অন্যতম সহযোগী। এজন্য পদে পদে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন।