ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রনিদিধি,২৩ সেপ্টেম্বর : স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের গাড়িচালক (বরখাস্ত) আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভার ওরফে বাদল হাজি সরকারি পুলের গাড়িচালক এবং তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নেতা হওয়ার সুবাদে হাতের মুঠোয় যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে যান। অন্তত ২০ বছর মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী সমিতির সভাপতি। ২০১৭ সাল থেকে সরকারি ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি জোট গঠন করে সেটিরও সভাপতি হন তিনি। দুই সংগঠনের নেতা হওয়ায় প্রভাব খাটিয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) থেকে চালক-পিয়ন পর্যন্ত পাঁচ ধরনের সিন্ডিকেটে তদবির বাণিজ্য করতেন তিনি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কয়েকজন নেতার মাধ্যমে শীর্ষ পর্যায়ে তদবির করতেন তিনি। প্রশাসনিক শাখা অফিসগুলোতে তাঁর বাণিজ্যের অংশীদার রয়েছেন অন্তত ১০ জন। নেতা হওয়ায় বিভিন্ন বিভাগের পরিচালকদের গাড়িচালকরাও জড়িয়ে পড়েন তাঁর তদবির সিন্ডিকেটে। সহযোগী গাড়িচালকদের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের হাত করতেন মালেক। যেসব কর্মকর্তা রাজি হতেন না তাঁদের ঘুষের অঙ্ক বাড়িয়ে দেওয়াসহ অন্য প্রলোভন দেখাতেন। এ কাজের জন্য আলাদা লোক রয়েছে মালেকের। যেসব কর্মকর্তা প্রলোভনের পরও কথা শুনতেন না, সহযোগীদের মাধ্যমে তাঁদের অনিয়মের তথ্য বের করে কয়েকজন অখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিক নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করাতেন। এরপর সেই অসৎ সাংবাদিকদের দিয়ে চাপে ফেলে তদবিরে রাজি করাতেন মালেক। ১০ বছর ধরে দোর্দণ্ডপ্রতাপে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাওয়া মালেক দুই-তিন বছর ধরে পেনশনের টাকা তোলার বাণিজ্য শুরু করেন। গ্রেপ্তারের আগে ও পরে র্যাব মালেকের অপকর্মের প্রাথমিক পর্যায়ের এসব তথ্য পেয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তুরাগ থানার পুলিশ মালেককে প্রথম দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি কর্মচারী হওয়ায় মালেকের দুর্নীতি ও অবৈধ অর্থ উপার্জনের সামগ্রিক তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। র্যাব-পুলিশের তদন্তে তাঁর ব্যাপারে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা দুদক চাইলে হস্তান্তর করা হবে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিলাহ বলেন, ‘অস্ত্র ও জাল টাকার অভিযোগের পাশাপাশি আয়ের সঙ্গে মিল নেই এমন অনেক তথ্যই আমরা পেয়েছি। সেই আয়ের উৎস নিয়েও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীরা খতিয়ে দেখবেন।’
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সংঘবদ্ধ অপরাধ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোস্তফা কামাল গতকাল ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, ‘সাধারণত অবৈধ সম্পদ পাচারের কোনো তথ্য পেলেই আমরা মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দায়েরের জন্য অনুসন্ধান শুরু করি। তবে মালেক যেহেতু সরকারি কর্মচারী, তাই এটি আমরা নই, দুদকই করবে।’
র্যাব ও পুলিশের সূত্র জানায়, ড্রাইভার মালেক ডিজিদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারী ও কর্মচারীদের নেতা হওয়ায় সবাই তাঁকে সমীহ করতেন। অন্য গাড়িচালকরা তাঁর কথার বাইরে যেতে পারতেন না। সাবেক ডিজি অধ্যাপক শাহ মুনীর হোসেনের সময় থেকেই মালেকের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। চালকের মাধ্যমে তিনি ইচ্ছামতো তেলের বিল তোলার ব্যবস্থা করেছেন। এর একটি কমিশন পেতেন মালেক। তিনি নিজেসহ কয়েকজন কর্মচারী প্রায়ই শীর্ষ কর্মকর্তাদের গাড়ি ব্যবহার করতেন। কেউ কখনো আপত্তি তুললে চালকদের একজোট করে গাড়ি চালানো বন্ধ করে দিতেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের শাখা অফিসগুলোতে মালেকের অন্তত ১০ জন অংশীদার রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে মিলে তদবির বাণিজ্য করতেন তিনি। তাঁদের মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগসংক্রান্ত নথিপত্র সংরক্ষণ করেন তিনি। এই কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে গড়ে তোলেন বাণিজ্য সিন্ডিকেট। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজির একান্ত সহকারী (পিএ) হিসেবে কর্মরত শাহজাহান ফকির। একাধিক ডিজির পিএ শাহজাহান কয়েক বছরে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তাঁকে দিয়ে অনেক তদবির বাণিজ্য করেছেন বলে দাবি মালেকের। অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম ড্রাইভার মালেকের ঘনিষ্ঠ। তাঁকে দিয়ে পেনশনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিগত ফাইলের তদবিরের কাজ করাতেন মালেক। প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির আহমেদ চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে একই পথে কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গেও রয়েছে মালেকের সম্পর্ক। অধিদপ্তরের প্রধান সহকারী জাহাঙ্গীর হোসেন হাওলাদার সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির টেকনিশিয়ানসহ বিভিন্ন পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন। আরেক প্রধান সহকারী জাকির হোসেন স্বাস্থ্য সহকারীদের ফাইল দেখেন। তাঁদের সঙ্গে আঁতাত করে স্বাস্থ্য সহকারী পদে তদবির করেন মালেক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মজিবুল হক মুন্সি, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর তোফায়েল আহমেদ ভুঁইয়া এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রশিক্ষণ ও মাঠ কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে ছিল মালেকের যোগাযোগ। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে চুক্তি করেন মালেক। পেনশনের টাকা দ্রুত সময়ের মধ্যে তুলে দেওয়ার জন্য ১০ থেকে ২৫ শতাংশ নিতেন তিনি ও অংশীদাররা।