ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি,০৬ সেপ্টেম্বর : গ্যাস লিকেজের অভিযোগ পেলেও ব্যবস্থা নেয়নি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ; বরং অভিযোগ পাওয়া গেছে, লিকেজ মেরামতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেছিল তিতাসের কর্মচারী ও ঠিকাদাররা। এর মধ্যেই ঘটে গেল মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে এশার নামাজের সময় বিস্ম্ফোরণে ঘটে গেছে বহু মুসল্লির হতাহতের ঘটনা। অনেকেই অভিযোগ করছেন, তিতাসের অবহেলার বলি হলেন নিরীহ এই মুসল্লিরা।
মসজিদের ভেতর জমে থাকা গ্যাসের কারণেই ভয়াবহ বিস্ম্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। এলাকাবাসী জানান, মাসখানেক ধরে মসজিদে গ্যাসের গন্ধ ছিল। মসজিদ কমিটি বলেছে, গ্যাস লিকেজের বিষয়ে তিতাসকে জানানো হয়েছিল। সমস্যার সমাধানের জন্য ৫০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চলছিল, এর মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এ দুর্ঘটনার দায় তিতাস এড়াতে পারে না। তারা আগে থেকে উদ্যোগ নিলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। যদিও তিতাস কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, গ্যাস লিকেজের কোনো অভিযোগ তাদের কাছে আসেনি। দুর্ঘটনার পর মসজিদের মেঝেতে জমে থাকা ‘পানিতে’ বুদবুদ চোখে পড়ে। এ বিষয়ে শুক্রবার রাতেই ফায়ার সার্ভিস জানায়, তিতাস গ্যাসের একটি পাইপলাইন ওই মসজিদের নিচ দিয়ে চলে গেছে। ওই লাইন থেকে লিকেজের ফলে জমে থাকা গ্যাস বিস্ম্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেলে গ্যাসের গন্ধ পেতেন। এক মাসের বেশি সময় ধরে গ্যাসের এই লিকেজের সমস্যা চলছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, টানা বৃষ্টির পর থেকে গ্যাসের বুদবুদ দেখা যায়। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মসজিদ কমিটিও ধারণা করতে পারেনি যে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পশ্চিম তল্লা এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সোহেল শেখ বলেন, আগে থেকেই মসজিদের ভেতরে গ্যাসের গন্ধ পেতাম। এসি চালানোর কারণে মসজিদের দরজা-জানালা বন্ধ থাকত। ভেতরে গ্যাস জমে গিয়েছিল।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন বলেন, গ্যাসের লিকেজ থেকে মসজিদের ভেতরে বিস্ম্ফোরণের ওই ঘটনা ঘটেছে। মসজিদের ভেতরে গ্যাস ভরে থাকায় বিদ্যুতের স্ম্ফুলিঙ্গ থেকে মুহূর্তে এ বিস্ম্ফোরণ হয়েছে। এখানে এসির কোনো বিস্ম্ফোরণ ঘটেনি। মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সপ্তাহখানেক আগে গ্যাস লিকেজের বিষয়টি তারা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের ঠিকাদারকে জানান। তখন ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। টাকা জোগাড় করার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
অভিযোগের বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জ অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক মফিজুল ইসলাম বলেন, তিতাস গ্যাসের লিকেজের অভিযোগ পেয়ে তাদের একটি দল কাজ করছে। কিন্তু মসজিদের নিচ দিয়ে তিতাস গ্যাসলাইন নেয়নি; বরং মসজিদ বর্ধিত করার কারণেই গ্যাসের লাইন মসজিদের নিচে চলে গেছে। তা ছাড়া ওই এলাকায় গ্যাস লিক হচ্ছে- এ দুর্ঘটনার আগে কেউ তাদের জানায়নি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ ঠিকাদারদের বলে থাকতে পারেন। সেটি তো আমাদের জানানো হলো না। তিতাস অফিসে গ্যাস লিকেজের অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তিতাস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিতাসের ঢাকা মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) আবদুল ওহাব তালুকদারকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের এই কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মো. আল মামুন গতকাল সন্ধ্যায় ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, তিনি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গ্যাস লিকেজের অভিযোগ পেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা হয়তো সঠিক নয়। কারণ, তাদের অফিসে কোনো অভিযোগ এলে তা খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়। নারায়ণগঞ্জ অফিস তাকে জানিয়েছে, গত সাত/আট মাসে ওই মসজিদে গ্যাস লিকেজের কোনো অভিযোগ তাদের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ নেই। তিনি জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কমিটি হয়েছে। সব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে তাদের। কমিটির প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা যাবে। তিতাসের এমডি আরও জানান, গ্যাসলাইনটি প্রায় ১০/১২ বছরের পুরোনো। ফলে মাটি খুঁড়ে লাইন না তোলা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না, আসলে কী ঘটেছে। লাইনটি কি অবৈধ ছিল, নাকি লাইনের ওপরে মসজিদ বানানো হয়েছে- তা তদন্তের পরই জানা যাবে।
বৈদ্যুতিক কারণে মসজিদে বিস্ম্ফোরণ ঘটেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) প্রধান প্রকৌশলী মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিতরণ লাইন থেকে মসজিদের মিটার পর্যন্ত সংযোগ অক্ষত রয়েছে। মসজিদের মিটারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তার পরও দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে দেখতে তাদের পক্ষ থেকে একটি কমিটি কাজ করছে।
এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল নারায়ণগঞ্জের দুর্ঘটনাস্থল ও ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড পল্গাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করেন।
জানতে চাইলে নসরুল হামিদ ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, তিতাস ও ডিপিডিসির দুটি কমিটি কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদন পেলে দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিতাসের দায় থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মসজিদের ভেতরে দেড় টনের ছয়টি এসি রয়েছে। এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, নিম্ন আয়ের মানুষ সেখানে বাস করে। এমন এলাকার একটি মসজিদে কীভাবে এত লোডের অনুমোদন দেওয়া হলো, সে বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে বলেছি। তিনি আরও জানান, গ্যাসের পাইপলাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণ হলো কীভাবে, সেটি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। এসব গ্যাস সংযোগ বৈধ না অবৈধ, সেটিও কমিটি যাচাই করে দেখবে। অবৈধ হলে স্থানীয় তিতাস অফিস ব্যবস্থা নিল না কেন, সেটাও দেখতে হবে।
যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে : তিতাসের সাবেক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে গ্যাস পাইপলাইনে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়, যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং সাবধান হওয়া যায়। এখন সম্ভবত এই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে এসে কোনো বদ্ধ জায়গায় জমা হলে এবং তার পরিমাণ বাতাসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হলে আগুন ধরার পরিবর্তে বিকট শব্দে বিস্ম্ফোরণ ঘটে। এর পরিমাণ ২০ শতাংশ পেরোলে অগ্নিকাে র ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জে হয়তো এ ধরনের কিছু ঘটেছে।
ঢাকাজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পাইপলাইন : ঢাকা বিভাগে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তিতাস গ্যাসের ১২ হাজার ২৫৩ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে সাত হাজার কিলোমিটার। যার ৭০ শতাংশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ২০ বছর থেকে শুরু করে ৪০ বছরের পুরোনো বিতরণ লাইনও রয়েছে। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লাইন পাল্টানো হলেও লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম তেমন নেই। এছাড়া অবৈধ সংযোগের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে। তিতাসের এক অনুসন্ধানে গত বছর দেখা যায়, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস বিতরণ লাইন রয়েছে। এগুলো মাঝেমধ্যে কিছু উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তিতাসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীর কারণে এগুলো পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না।
ঢাকা ছাড়াও নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর এবং কিশোরগঞ্জে তিতাসের পাইপলাইন আছে। এর মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমাণ বেশি। মূল লাইন থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে সাধারণ পাইপে বাসাবাড়ি ও কারখানায় গ্যাস নেওয়া হয়। এসব অনিরাপদ সংযোগ থেকে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় রাস্তা সংস্কারের কারণে পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকেই। গত ২৩ জুলাই রাজধানীর বংশালে গ্যাসলাইন বিস্ম্ফোরণে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি)কে তখন বলেছিলেন, ঢাকার গ্যাস পাইপলাইনের বেশিরভাগ ৩৫-৪০ বছরের পুরোনো। এগুলোর সবই প্রায় জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। এ শহরে ৫০ বছরের পুরোনো পাইপলাইনও রয়েছে। তিনি বলেন, এসব লাইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিতাসের জন্য ১২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজধানীতে দুই হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন করা হবে। সঞ্চালন ব্যবস্থা স্ক্যাডার আওতায় আসবে।