প্রতারক সাহেদের আত্মপ্রচারের প্ল্যাটফর্ম ছিল ফেসবুকও

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),ঢাকা প্রতিনিধি,১১ জুলাই :
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুককে আত্মপ্রচারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতেন বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিষয়ে তার পোস্ট থাকত। ওইসব পোস্ট থেকে মানুষের জন্য, সমাজের জন্য নানা উপদেশ ও জ্ঞান দিতেন তিনি।

মো. সাহেদ ১ জুন ফেসবুকে পোস্ট করেন একটি লাইন- ‘রঙ্গমঞ্চের মাধ্যমে জীবনের নবরূপায়ণই নাটক।’ এই বাক্যের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ড মিলিয়ে এখন চলছে নানা আলোচনা।

সাহেদের ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তার অনেক পরিচয়। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান ছাড়াও সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চের চেয়ারম্যান তিনি। এ ছাড়া লেখা রয়েছে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপকমিটির সদস্য, ন্যাশনাল প্যারা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, কর্মমুক্তি কর্মসংস্থান সোসাইটির চেয়ারম্যান, রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধারও তিনি। তার বিরুদ্ধে সংক্রামক ব্যাধি আইনে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে।

গতকাল পর্যন্ত ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা ছিল ছয় হাজারের মতো। একাধিক মন্ত্রী থেকে সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে তোলা ছবি ফেসবুকে প্রায়ই পোস্ট করতেন তিনি। সর্বশেষ চার দিন আগে তার পোস্ট রয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘ঢাকার প্লাজমা ব্যাংক কোথায় রয়েছে। বাবার জন্য বি(+) ব্লাডের প্লাজমা প্রয়োজন।’ কয়েক দিন আগে করা একটি পোস্টে তিনি দাবি করেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতালের নামে প্রতারক চক্রের করোনা স্যাম্পল সংগ্রহ ও অর্থ আদায়।’

২৯ জুন একটি পোস্টে সাহেদ লেখেন- ‘দয়া করে পোস্টটি কেউ এড়িয়ে যাবেন না। প্রতিদিন আমি একটি সচেতনতামূলক পোস্ট শেয়ার করার চেষ্টা করি।’

২৩ জুন একটি পোস্টে তিনি বলেন, ‘করোনা নিয়ে আতঙ্ক নয়। বাড়াতে হবে সচেতনতা। সেবাই ধর্ম।’ নতুন কাগজ নামে অখ্যাত যে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক সাহেদ তার ব্যানারে প্রায়ই অনলাইন টকশোর আয়োজন করতেন তিনি। এর নাম দিয়েছিলেন নতুন কাগজ সংলাপ। সেখানে তিনি সমাজের শ্রেণিপেশার প্রভাবশালী মানুষকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করতেন। যে যেমন টিভি টকশোর বক্তা হিসেবে আবির্ভাব ঘটান, তেমনি নিজেই অনলাইনে টকশোর উপস্থাপক হিসেবে প্রায়ই হাজির হতেন।

১৭ জুন একটি পোস্টে এই মহা প্রতারক লেখেন- ‘কেউ পোস্ট এড়াবেন না। যেহেতু আমি নিজে কভিডে আক্রান্ত হয়েছি এবং আল্লাহর রহমতে সুস্থও হয়েছি। দুটি কভিড হাসপাতাল পরিচালনা করছি। তাই অনুরোধ করব বেশি বেশি করে কভিড টেস্ট করুন।’

৫ জুন একটি পোস্টে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডারের ১৮তম বিসিএসের সব বন্ধুসহ যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত সবাইকে অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা। নিজে কোন দিন টিভিতে টকশোতে থাকবেন সেই ধরনের পোস্ট একাধিক দিন দিয়েছেন। ৪ জুন একটি পোস্টে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিবকে অভিনন্দন জানান। আর বিদায়ী সচিবের জন্য শুভকামনা জানান। ১৯ মে ফেসবুকে তার একটি পোস্ট সত্যি নাটকীয়। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুর্নীতি নিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘বেচারা অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার কতগুলো টাকা দিয়ে একদিন আগে অ্যাডিশনাল চিফ ইঞ্জিনিয়ার হলো। আর একদিন পরই চাকরি চলে গেল। তবে উনি কিন্তু খুব লয়াল। কাউকে ভাগ না দিয়ে খেতেন না। আরেকজন যিনি সাসপেন্ড হয়েছেন মিস্টার ইউসুফ সাহেব। উনি আবার সাদেক হোসেন খোকা সাহেবের খুব কাছের লোক ছিলেন। ফাইল আটকে কীভাবে পয়সা নেওয়া যায়, এই দু’জন খুব ভালো করে জানতেন। আরও কিছু ওস্তাদ রয়েছে। রাঘববোয়াল ধরা হয়েছে আশা করি চুনোপুঁটিও ঠিক হয়ে যাবে।’ এই পোস্ট যেন ভূতের মুখে রাম নাম!

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সাহেদের চিঠি : জানা গেছে, রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা চিকিৎসাসেবায় যাতে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে এ জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেখানে ডাক্তার ও নার্স পাঠানো হয়। তবে ১৬ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেন সাহেদ। সেখানে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যেসব ডাক্তারকে রিজেন্ট হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে তাদের যেন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আপাতত রিজেন্ট হাসপাতালে ডাক্তারের প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতে দরকার হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হবে তারা।

এক সহযোগী রিমান্ডে : রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসায় অনিয়ম ও প্রতারণার ঘটনায় সাহেদের অন্যতম সহযোগী তরিকুল ইসলাম ওরফে তরিক শিবলীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে বৃহস্পতিবার রাজধানীর নাখালপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব।

শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চেয়েছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার পরিদর্শক আলমগীর গাজী। শুনানি শেষে বিচারক পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এর আগে গত বুধবার রিজেন্ট হাসপাতালের অ্যাডমিন, টেকনোলজিস্টসহ সাতজনের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ওই সাতজন হলেন- রিজেন্ট হাসপাতালের অ্যাডমিন আহসান হাবীব, এক্স-রে টেকনেশিয়ান আহসান হাবীব হাসান, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হাতিম আলী, হেড অফিসের অ্যাডমিন রাকিবুল ইসলাম, এইচ আর অ্যাডমিন অমিত বণিক, ড্রাইভার আবদুস সালাম এবং এক্সিকিউটিভ অফিসার আবদুর রশিদ খান। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় রিসিপশনিস্ট কামরুল ইসলামকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

এখনও পলাতক সাহেদ : চিকিৎসার নামে বাণিজ্যের ঘটনার মূল হোতা সাহেদ এখনও পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারে একাধিক জায়গায় নজরদারি চলছে। চার দিন আগের স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন সাহেদ। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তবে যে কোনোভাবে সাহেদকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আশাবাদী গোয়েন্দারা।

কে এই তরিক : জানা গেছে, প্রতারক সাহেদের সেকেন্ড ইন কমান্ড রিজেন্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা তথাকথিত সাংবাদিক তরিকুল ইসলাম ওরফে তরিক শিবলী। তার পরিচয় ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। রিজেন্ট হাসপাতালের জালিয়াতি মামলার তিন নম্বর আসামি হিসেবে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার এ ব্যক্তিই সাহেদের যাবতীয় অপকর্মের দোসর ও ডান হাত হিসেবে অনেকে মনে করছেন। খোদ সাহেদের স্ত্রী সাদিয়া আরাবি রিম্মিও মনে করছেন, তার স্বামীর অনেক অপকর্মের সঙ্গী তরিক। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে এই শিবলী বিতর্কিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ ছিল বলেও জানিয়েছেন সাদিয়া।

তরিক শিবলীর প্রতারণার অন্ত নেই। আদম কারবারের দালালি, ব্যাংক লোন করা, তদবির-বাণিজ্য, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, স্কুল ও কলেজে পড়ুয়া মেয়েদের মডেল ও আরজে বানানোর নামে অসামাজিক কাজ করানোই ছিল তরিক শিবলীর কাজ। করোনাকালে হঠাৎ ডাক্তার পরিচয়ে করোনা রোগীর স্যাম্পল কালেকশন করেন। গাড়িতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার ব্যবহার করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য করোনা টেস্টে আগ্রহীদের নমুনা সংগ্রহ করেছেন।

জানা যায়, কুমিল্লা সদরে জন্মগ্রহণ করা তরিকুল ইসলাম কলেজের গণ্ডি পার হতে না পারলেও নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস বলে পরিচয় দিতেন। সরকারদলীয় ও বেসরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরিচয় দিয়ে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। আশকোনা এলাকায় স্পর্শ বাংলা নামে অনলাইন চালু করে মডেল ও আরজে বানানোর নামে তৈরি করেন প্রতারণার ফাঁদ। হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। পাওনাদারদের চাপের মুখে রাতের আঁধারে বাসা ছেড়ে পালিয়ে টঙ্গী মধুমিতা রোডে বাসা পরিবর্তন করেন। ২০১৭ সালে রিজেন্ট গ্রুপ করে কয়েক মাসের মধ্যে জিএম পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী আনার কাজটি করেন শিবলী। কখনও নতুন কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার আবার কখনও চিফ রিপোর্টার পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন ও সাংবাদিক পরিচয়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অপকর্ম করে বেড়াতেন।