খুলনার ৩ ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ ৪ অভিযোগ

SHARE
অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান (বাঁ থেকে) শেখ আনিছুর রহমান, মো. ফিরোজ মোল্লা ও গাজী জাকির হোসেন।

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,খুলনা প্রতিনিধি,১১ জুন : খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সদর, বারাকপুর ও যোগিপোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তিন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ‘জমি আছে, ঘর নেই প্রকল্পে’ দুর্নীতি, ত্রাণের চাল বিতরণে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও সরকারি বরাদ্দ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

এসব অভিযোগের কারণে ঝাড়ু মিছিল এবং বিক্ষোভও হয়েছে। এমনকি ইউপি সদস্যরা তাদের অপসারণের দাবিতে প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে অনাস্থা প্রস্তাবও দিয়েছেন।

অভিযুক্তরা হলেন- যোগিপোল ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান, সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. ফিরোজ মোল্লা ও বারাকপুর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন।

বিষয়গুলো আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখছে স্থানীয় প্রশাসন। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও মিলেছে। তবে, অভিযুক্তরা বরাবরই সব অভিযোগ অস্বীকার করে প্রতিপক্ষকে দায়ী করে চলেছেন।

যোগিপোল ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান : উপজেলার যোগিপোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে ‘জমি আছে, ঘর নাই’ প্রকল্পে অনিয়ম এবং ভিজিডি-ভিজিএফ কার্ডের চাল আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এমনকি ইউনিয়নের মেম্বররাও তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন।

যোগিপোল ইউনিয়নের বাসিন্দা সাহানারা বেগম, রাজিয়া সুলতানা, মনিরা বেগম, শামছুন্নাহার, লিপি বেগম, চম্পা বেগম, রাবেয়া বেগম, আয়শা বেগম, নিলুফা বেগম, ইয়াসমিন আক্তার, নজরুল ইসলামসহ অনেকেই তাদের কার্ডের প্রাপ্ত চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির ভিজিএফ কার্ডের ক্ষেত্রেও একই অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগী মোছা. আসমা খাতুন বলেন, ‘আমি গর্ভবতী হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে বিশ্রামে রয়েছি। আমি আমার চাল আনতে অন‌্য একজনকে পাঠিয়েছিলাম। তাকে চাল দেওয়া হয়নি। বিষয়টি জানতে গেলে চেয়ারম্যানের ভাই আমার স্বামীকে মারতে আসেন। এমনকি গত বছর আমার নামে কার্ডের চাল তোলা হয়েছে, অথচ আমি তা জানি না।’

অপরদিকে, ‘জমি আছে ঘর নাই’ প্রকল্পে অসহায় দরিদ্রদের বিনামূল্যে ঘর দেওয়ার কথা রয়েছে। তবে চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান ৪১০ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে প্রায় এক কোটি টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন। এমন অভিযোগ এনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত দিয়েছেন মো. রেজাউল ইসলাম ও রুমা খন্দকার মুন্নি নামের দুই ব্যক্তি।

সূত্র মতে, গত বছরের ১০ অক্টোবর মুরাদ হোসেন ও আলী হাওলাদার নামের এক ব্যক্তির টাকা ফেরৎ দিয়ে তার ঘর ভেঙ্গে ফেলা হয়। ঘরের টাকা ফেরৎ দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ঘর পাওয়ায় আশায় টাকা দেওয়া জোহরা বেগম, সুফিয়া বেগম, হোসনে আরা বেগম, নার্গিস সুলতানা, সেলিনা বেগম, শামসুরন্নাহার, নিলুফা তাদের ঘর অথবা টাকা ফেরৎ পেতে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে জয়নাল আবেদিন এবং নিলুফার ইয়াসমিন নামের দুই ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলনও করেন।

এদিকে, সর্বশেষ গত ৭জুন ইউনিয়নের ১২ সদস্যের (মেম্বার) মধ্যে ১০ জন দিঘলিয়া উপজেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. গোলাম সরোয়ার খানের কাছে গণঅনাস্থার লিখিত আবেদন জমা দিয়েছেন।

অনাস্থা দেওয়া ইউপি সদস্যরা হলেন- ফিরোজা বেগম, হাফিজা বেগম, কাজী শহিদুল ইসলাম, গাজী কবির হোসেন, আবুসাঈদ হাওলাদার, শেখ গোলাম কিবরিয়া, রফিকুল ইসলাম, শেখ আমজাদ হোসেন, আমিরুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম।

অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমার নামে যেসব অভিযোগ করা হযেছে তা ভিত্তিহীন। আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারই অংশ হিসেবে এসব অভিযোগ করা হচ্ছে।’

সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. ফিরোজ মোল্লা : খুলনার দিঘলিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. ফিরোজ মোল্লার বিরুদ্ধে ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত ত্রাণের চাল আত্মসাৎ ও তালিকা প্রণয়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

এ ঘটনায় সাত জন ইউপি সদস্য এ বিষয়ে প্রতিকার এবং নীতিমালা অনুযায়ী প্রকৃত উপকারভোগীদের মধ্যে চাল বিতরণের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য গতকাল বুধবার (১০ জুন) বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।

অভিযোগকারীরা হলেন- ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য এবিএম আতিকুল ইসলাম, ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য শেখ মোয়াজ্জেম হোসেন, ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. আজিজুর রহমান, ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য মোল্লা হারুন-অর-রশীদ, ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য খান বিপ্লব হোসেন এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য হাফিজা খাতুন ও রিনা পারভীন।

লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ১৪ এপ্রিলের জিআর স্মারকে বরাদ্দকৃত তিন হাজার ১৫৩ মেট্টিক টন চাল ও ২৭ হাজার ৮২৫ টাকা এবং ২১ এপ্রিলের জিআর স্মারকের পাঁচ হাজার ৫৬৫ মেট্টিক টন চাল ও ৩২ হাজার ৬৪৮ টাকা চেয়ারম্যান ফিরোজ মোল্লা আত্মসাৎ করেছেন।

এছাড়া ৩০ এপ্রিলের স্মারকে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ি তিনি ওয়ার্ড মানবিক সহায়তা কমিটির মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের তালিকা প্রণয়ন করেননি। খেয়াল খুশিমত নিজের লোকদের মধ্যে তালিকা করায় প্রকৃত ভোগীরা বঞ্চিত হয়েছে।

ইউনিয়নের সদস্য এবিএম আতিকুল ইসলাম, শেখ মোয়াজ্জেম হোসেন, মো. আজিজুর রহমান, মোল্লা হারুন-অর-রশীদ অভিযোগ করে বলেন, ‘চেয়ারম্যান নিজস্ব লোক দিয়ে তালিকা করেছেন। তিনি নির্বাচিত সদস্যদের না জানিয়ে একতরফা সিদ্ধান্তেই এসব অনিয়ম করছেন। এর প্রতিকার চাই।’

অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান মোল্লা ফিরোজ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি চাল বিতরণ করেছি। কোনো অনিয়ম হয়নি। প্রতিপক্ষ ঈর্ষান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে এসব বানোয়াট অভিযোগ করছে।’

বারাকপুর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন : দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে নারীরা ঝাড়ু মিছিল করেছে। গতকাল বুধবার (১০ জুন) উপজেলার বারাকপুর বাজার ও লাখোহাটি গ্রামে এই ঝাড়ু মিছিল করা হয়।

ঝাড়ু মিছিল শেষে সংবাদ সম্মেলনে করেন বারাকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শেখ হাফিজুর রহমান।

তিনি অভিযোগ করেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান জাকিরের কর্মকাণ্ডে বারাকপুর ইউনিয়নবাসী অতিষ্ট। তিনি সরকারের ভিজিডি কার্ড, আরএমপির কর্মসূচি, এলএসপির কর্মসূচি, কম মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি, কাবিখা ও টেস্ট রিলিফ, মাদক ব্যবসা, জুয়ার আসর বসিয়ে অবৈধ টাকা আদায়, সরকারি সারের গোডাউন থেকে কোটি টাকার সার চুরি, লাখোহাটি ফুটবল ময়দানে বালু ভরাটের নামে প্রজেক্ট দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, সরকারি খাল দখল করে মাছ চাষ, কামারগাতী ওয়াপদার জায়গা দখল করে পাকা ঘর নির্মাণ, জমি আছে ঘর নেই প্রকল্পে প্রতিটি ঘর থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় ও মদ্যপ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের মারধর করাসহ বিভিন্ন অত্যাচার চালিয়ে আসছেন।’

তার বিরুদ্ধে ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের গণস্বাক্ষর করা লিখিত অভিযোগ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান গাজী জাকির হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘একটি পক্ষ নারীদের বাড়ি থেকে ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে ডেকে এনে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মিছিল করিয়েছে।’

তিন চেয়ারম‌্যানের বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হাফিজ আল আসাদ গণঅনাস্থার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে তদন্ত করা হবে। প্রয়োজনে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কপি পেয়েছি। এসব অভিযোগ স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে তদন্ত করে দেখা হবে। সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’