ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,খুলনা প্রতিনিধি,২৬ মে : খুলনা শহরের গলিপথে শরীরের সঙ্গে প্লাস্টিকের ছোটো-বড়ো ২০টি বয়াম (জার) বেঁধে হাঁটছিলেন যুবক। বয়ামে রাখা আতর, টুপি, তাসবিহ, মিসওয়াকসহ নানা মালামাল। সবই বিক্রির জন্য।
৩৫-৩৬ বছর বয়সের যুবকটি অন্ধ। নাম মো. আজিজুর রহিম। ছোট বেলা থেকেই পৃথিবীর আলো দেখা থেকে বঞ্চিত। দু’ বছর বয়স থেকেই দু’ চোখ অন্ধ তার। কিন্তু ভিক্ষার পথ নয়, এভাবে শরীরে মালামাল বেঁধে তা বেচেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে এভাবেই শরীরে বয়ামগুলো বহন করছেন তিনি। এ কারণে অনেকে তাকে ‘বয়াম মানব’ বলেও চেনেন। তিনি জানান, তিনি নাকি সুন্নতি ব্যবসা করছেন। এ কারণে, অন্ধ বলে কেউ ঠকালেও তার কোনো লস নেই।
আজিজুর রহিম খুলনা মহানগরীর পশ্চিম টুটপাড়া এলাকায় পৈত্রিক ভূমিতে বসবাস করেন। বাবা মো. আকতার উদ্দিনের বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরির সুবাদে ও জন্মসূত্রে খুলনায় বসবাস তাদের। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ সন্তান।
অন্ধ হলেও আজিজুর রহিম শিক্ষিত। নগরীর গোয়ালখালি অন্ধ বধির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর সরকারি বোডিং (হোস্টেল) এ থেকে নড়াইল তুলারামপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। এইচএসসিতে ভর্তি হন নগরীর দৌলতপুরস্থ ডে-নাইট কলেজে। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আর সামনে এগোতে পারেননি। ইতি টানতে হয় লেখাপড়ার। এরপর দু’ বছর ঘরে বসেই সময় কাটান। এভাবে বসে না থেকে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসার উদ্যোগ নেন তিনি। ২০১০ সাল থেকেই শুরু হয় তার ব্যবসার যাত্রা। যা এখনও চলছে।
অন্ধ আজিজুর রহিমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরো জানান, একটি শক্ত রশিতে প্লাস্টিকের ২০টির মত বয়াম সারিবদ্ধভাবে বাঁধেন তিনি। এরপর ওই রশি শরীরে বেঁধে বয়ামগুলোতে আতর, টুপি, তাসবিহ, সুরমা, মিসওয়াক, ব্রাশ, নামাজ শিক্ষা এবং ওজিফাসহ বিভিন্ন ধরণের পণ্য নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় নেমে পড়েন।
তিনি জানান, এসব পণ্য পাইকারি মূল্যে কেনেন নগরীর হেলাতলা মার্কেট থেকে। সাধারণত: এসব পণ্য ধর্মভিরু মুসলমানরা ব্যবহার করায় তিনি বিক্রির স্পট হিসেবে মসজিদগুলোকে বেছে নেন। নামাজ শেষে তিনি শরীরে বাঁধা পণ্য নিয়ে মসজিদের সামনে দাঁড়ালে মুসল্লিরা তার বয়াম থেকে পণ্য নিয়ে মূল্য তাকে বুঝিয়ে দেয়। এ ছাড়া মাঝে-মধ্যে রেলস্টেশন ও নিউমার্কেট এলাকায়ও যান তিনি।
বর্তমানে করোনা’র সংকটে সরকারের বিধি নিষেধ আরোপের কারণে মসজিদগুলোতে মুসল্লির সংখ্যা সীমিত হয়ে পড়ায় তিনিও ব্যবসার স্পটে পরিবর্তন এনেছেন। এখন খুলনা শপিং কমল্পেক্স, হেরাজ মার্কেট ও পিটিআই মোড় এলাকাতেই ঘোরাফেরা করেন তিনি। এখন সারাদিন ঘুরে ৪শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি হয় তার। এতে সামান্য লভ্যাংশ থাকে। মালামাল বিক্রির জন্য তার শরীরে একটি টিনের সাইনবোর্ডও ঝুলানো রয়েছে।
তিনি জানান, ব্যবসার শুরুর দিকে তিনি পলিথিনের ব্যাগে করে মালামাল বহন করতেন। কিন্তু সেগুলো বেশি দিন যেত না, ছিড়ে নষ্ট হয়ে যেত। পরবর্তীতে প্লাস্টিকের বয়ামেই মালামাল বহন শুরু করেন। তবে, প্লাস্টিকের বয়েমগুলো রোদে গরম হয়ে গেলে তার শরীরেও তাপ লাগে। এতে তার কিছুটা সমস্যা হয়।
অন্ধ হওয়ায় এ ব্যবসা করতে গিয়ে কখনো কথনো নানা বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয় তাকে। যেমন- চলার পথে কারও শরীরে বয়েমের ঘঁষা লাগলে তারা উত্তেজিত হয়ে তাকে বকা-ঝকা করে। আবার অসৎ লোকেরা তাকে ফাঁকিও দেয়। রমজান মাসের এমন একটি ঘটনার উল্লেখ করে তিনি জানান, জনৈক ব্যক্তি ১০ টাকা মূল্যের একটি ব্রাশ তার কাছ থেকে নিয়ে ২০ টাকার নোট দিয়ে ১০০ টাকার কথা বলে। তিনি বিশ্বাস করে তাকে বাকি টাকা ফেরতও দেন। কিন্তু বিষয়টি তার কাছে সন্দেহ হওয়ায় পরক্ষণে একটি মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানিয়ে দেন যে সেটি ১০০ টাকা নয়, ২০ টাকার নোট। এভাবে তাকে ঠকায়। এতে তার খারাপও লাগে। আবার অনেকেই ভালো আচরণও করে তার সঙ্গে।
দু’ চোখ অন্ধ হলেও কোন ধরণের সরকারি অনুদান বা সহায়তা পান না আজিজুর রহিম। তবে, এখন আর পাওয়ার আশাও করেন না তিনি। হতাশার সুরে কিছুটা দম নিয়ে বলেন, ‘কি দরকার, ওরা আমাকে কাটা ছাড়া তো আর মাছ দেবে না।’
অন্ধ হওয়ার পরও ভিক্ষার পথ বেছে না নিয়ে কেন ব্যবসা- এমন প্রশ্নের জবাবে আজিজুর রহিম বলেন, ‘প্রথমত: ভিক্ষা করা আমার কাম্য না, দ্বিতীয়ত: ভবিষ্যতে অসুস্থ হয়ে পড়লে যেন কারও কাছে হাত পাতা না লাগে- সে জন্য কষ্ট হলেও ব্যবসা করে কিছু কিছু করে অর্থ সঞ্চয় করছি। এছাড়া আমার যতটুকু আয়ত্ব আছে, ততটুকু দিয়েই আমি চলার চেষ্টা করি।’