ডিসি সুলতানা পারভীন ও আরডিসি নাজিম উদ্দিন।
ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,ষ্টাফ রিপোর্টার,১৮ মার্চ : প্রত্যাহারের নির্দেশ পাওয়ার পরও দুই মৎস্যজীবীকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছেন বিতর্কিত রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, জামিনে মুক্ত ওই দুই মৎস্যজীবীর একজনকে ধরে নিয়ে হুমকি দেন নাজিম।
মঙ্গলবার দুপুরে জেলগেট থেকে এক মৎস্যজীবীকে ধরে ডিসি অফিসে নিয়ে নাজিম ভয় দেখান, ‘তোকে তো র্যাব খুঁজতাছে, তোর বাঁচার কোনো পথ নাই। তোকে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেবে।’
ভুক্তভোগী ওই মৎস্যজীবীর নাম বিশ্বনাথ নম দাস। মঙ্গলবারই এক গণমাধ্যমকে আরডিসি নাজিম তাকে এভাবে ভয় দেখিয়েছে বলে জানান বিশ্বনাথ।
বিশ্বনাথ নম দাস বলেন, ‘জামিনে মুক্তি পেয়ে ১৭ মার্চ দুপুরে কুড়িগ্রাম কারাগার থেকে বের হই। বের হওয়ার পরপরই আমাকে জেলা প্রশাসনের গেস্টরুমে ধরে নিয়ে যান নাজিম উদ্দিন। সেখানে আমাকে তিনি বলেন, তোকে এখন যেসব কথা বলব তুই সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলবি না।’
এরপর আমাকে তিনি হুমকি দেন, ‘তোকে র্যাব খুঁজছে। ক্রসফায়ারে না পড়তে চাইলে কুড়িগ্রামের বাইরে চলে যা। এরপর আমাকে কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এলাকায় নিয়ে গিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়।’
আরডিসি নাজিম কেন মৎসজীবীকে কুড়িগ্রাম ছাড়া করতে চায় এমন প্রশ্নে জানা গেছে, বিশ্বনাথসহ খালেকুজ্জামান মজনু নামে আরো এক মৎসজীবীকে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরী থেকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন নাজিম। অভিযোগ রয়েছে কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশেই এ কাজটি করেন নাজিম।
গিরাই নদী বিল লিজ নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করায় ওই দুই মৎসজীবীর ওপর ক্ষুব্ধ হন ডিসি সুলতানা পারভীন। এর পরই তার নির্দেশে তাদের তুলে নিয়ে বেধড়ক পেটায় আরডিসি নাজিম উদ্দিন।
এ সময় তাদের হুমকি দিয়ে নাজিম বলেন, ‘মামলা তুলবি না, তোর কোন বাপ বাঁচায় এখন দেখি? পাঁচদিন পর পর তোকে রিমান্ডে নেব।’
বিশ্বনাথ বলেন, ‘তুলে আনার দিন আরডিসি নাজিম আমাকে বলেন, পাঁচ দিন পর পর রিমান্ডে নেব তোকে। দেখি তোর কোন বাপ বাঁচাতে আসে। সে রাতে আমাকে এক বছর ১১ মাস ১ দিন সাজা দেন তিনি। আর একজনকে ছয় মাস সাজা দেন। অথচ আমাদের কোনো অপরাধ ছিল না। আমরা শুধু গিরাই নদী বিল লিজ নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেছি। এটাই আমাদের অন্যায়। আমরা এর বিচার চাই।’
উল্লেখ্য, আরডিসি নাজিমের নির্যাতনে আহত বিশ্বনাথ নম দাস মুক্তি পাওয়ার পর কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
এমন সব অভিযোগের বিষয়ে মৎস্যজীবী বিশ্বনাথ নম দাস ও খালেকুজ্জামান মজনুকে মারধর করেননি বলে দাবি করেছেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন স্যারের নির্দেশে সেদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। সরকারি কাজে বাধা প্রদানের অপরাধে বিধিমোতাবেক তাদের পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় সাজা দেয়া হয়।’
কিন্তু ওই রাতের মোবাইল কোর্ট বিষয়ে কিছুই জানেন না নাগেশ্বরী থানার ওসি রওশন কবির।
তিনি বলেন, ‘আমি ২৬ ফেব্রুয়ারি স্টেশনেই ছিলাম। কিন্তু ওই দিন কোনো মোবাইল কোর্ট দিনে কিংবা রাতে করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এমনকি আমার থানার কোনো পুলিশ সদস্য মোবাইল কোর্টে পাঠানো হয়নি।’
একইরকম বক্তব্য পাওয়া গেছে নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহমেদ মাসুমের থেকে।
তিনি বলেন, ‘২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরীতে আরডিসি নাজিম উদ্দিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন বলে কোনো তথ্য নেই আমার অফিসে।’
উল্লেখ্য, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আরডিসি নাজিম উদ্দিন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গিয়ে দুই মৎস্যজীবীকে তুলে ডিসির কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। রাতেই তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগে পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় বিশ্বনাথ নম দাসকে এক বছর ১১ মাস এক দিন এবং খালেকুজ্জামান মজনুকে ছয় মাসের বিনাশ্রম সাজা দেয়া হয়। পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন নিজেই খালেকুজ্জামান মজনুকে জামিন দেন। এরপর বিশ্বনাথ নম দাস গত ১ মার্চ আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন। হঠাৎই ১৬ মার্চ সন্ধ্যায় গোপনে বিশ্বনাথ নম দাসকে জামিন দেন এডিএম সুজা উদ দৌলা।
এদিকে জানা গেছে, বিতর্কিত আরডিসি নাজিম উদ্দিন কুড়িগ্রাম যাওয়ার আগে একই দায়িত্বে ছিলেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলাতে।
ওই সময় তিনি সাংবাদিক রিগ্যানের মতোই ব্যক্তি আক্রোশে স্থানীয় ঔষধ ব্যবসায়ী আবু জাফর বাদশা ফকিরকে মোবাইল কোর্টে এক বছরের সাজা দেন। এ ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে তিনি স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
মহম্মদপুর উপজেলায় এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত অবস্থায় তিনি এরকম অসংখ্য ঘটনায় জড়িয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা থাকায় অধিকাংশ মানুষ টু শব্দটি পর্যন্ত করতে সাহস পায়নি। তবে সে সময় নহাটা বাজারের ব্যবসায়ীরা তার অপসারণ দাবি করে বাজারে বিক্ষোভ করেন।
মহম্মদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা সিদ্দিকী লিটন যুগান্তরকে বলেন, নাজিম উদ্দিন নহাটা বাজারে পেরিফেরির কথা বলে সেখানকার স্থায়ী ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের চেষ্টা চালান। তার কর্মচারীদের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায় করেন। যারা প্রতিবাদ করতে গেছে গেছে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ভাঙচুর চালান।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার মধ্যরাতে কুড়িগ্রামে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে মারধর করে তুলে নিয়ে যায় নাজিম। তার বাসায় আধা বোতল মদ ও ১৫০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ আনা হয়। এরপর গভীর রাতে জেলা প্রশাসকের অফিসে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।