না.গঞ্জে ঝুলে আছে বিতর্কে থাকা ৩৩৫ মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্য

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,নারায়নগঞ্জ প্রতিনিধি,২৬ ডিসেম্বর : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছেÑ নারায়ণগঞ্জ জেলার এমন ১২ মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। জামুকার সুপারিশের ভিত্তিতে গেজেট ও সনদ বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির পরই তাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এখনও ঝুলে আছে বিতর্কের বেড়াজালে থাকা নারায়ণগঞ্জের ৩৩৫ মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্য।

জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা ননÑ এমন ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা বানানো এবং জাল সনদের জন্য বেশকিছু চক্র গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বিভিন্ন ইউনিটের কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার সমন্বয়ে মূলত এসব চক্র গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির বয়স দুই বছর বাড়ানো, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনির জন্য নির্ধারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাঝুলে আছে বিতর্কে থাকা
ষ শেষ পৃষ্ঠার পর
সনদ জালিয়াতির প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা শনাক্ত এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই শুরু হয়।
সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জ জেলায় বর্তমানে সরকারের ভাতাভোগী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ হাজার ৮৪৩ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪৭৭ জন, বন্দর উপজেলায় ২১০, সোনারগাঁ উপজেলায় ৪৩২, আড়াইহাজার উপজেলায় ৩৮২ ও রূপগঞ্জ উপজেলায় ৩৪২ জন। তবে এর মধ্যে যাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তিÑ সদরে চারজন, বন্দরে ১০০, সোনারগাঁয়ে ১৬১, আড়াইহাজারে ৭৯ ও রূপগঞ্জে তিনজন। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা ৩৪৭ জন। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় আসাদুজ্জামান, আজাহারউদ্দিন, মতিউর রহমানসহ চারজনের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত নয়। তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের কাছে অভিযোগ জমা পড়েছে।
বন্দর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাত নেতাও রয়েছেন বিতর্কের বেড়াজালে। এছাড়া বন্দরে ১০০ জনকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে ৩৬ জনকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বলে উকিল নোটিশ দেন মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগর ও মুক্তিযোদ্ধা জিকে বাবুল। পরে ৫ ডিসেম্বর ওই ৩৬ জন দুই মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে বন্দর থানায় একটি জিডি দায়ের করেন। এফএফ ২নং যুদ্ধকালীন গ্রুপ কমান্ডার ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া ইউনিয়নের ষোল্লপাড়া গ্রামের আবু আহম্মেদ মুন্সির ছেলে মো. শফিউর রহমান সোনারগাঁয়ের ১৬৯ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেন। সোনারগাঁ উপজেলাতেই সবচেয়ে বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি সোনারগাঁ উপজেলা কমান্ডার সোহেল রেজার বিরুদ্ধেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিও পালিত হয়। পরে তাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া আড়াইহাজারে ৭৯ জন ও রূপগঞ্জে তিনজনকে নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। পরে ২০১৭ সালের মার্চে হাইকোর্টের নির্দেশে সারা দেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
চলতি বছরের ১৩ ডিসেম্বর শুনানিতে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৮৫ জন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের সুপারিশের ভিত্তিতে গেজেট ও সনদ বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারির পরই তাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জামুকার ৬৬তম সভায় এসব সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলার ১২ মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এরা হলেন আবুল কালাম (১৬২৮), আবদুর রহমান (৩৯৬), আলী হোসেন (৪০৪), শাহাব উদ্দিন (৪১১), মো. লিয়াকত আলী (৪৩০), মো. আলী (৩৮০), আবদুল বাতেন (৪২৮), ইছাক মিয়া (৬৫৩), নুর মোহাম্মদ মোল্লা (৯৩১), মো. গিয়াস উদ্দিন (১৫৩২), খন্দকার আবু জাফর (১৫২১) এবং মো. কামাল হোসেন (১৫৪৯)। এছাড়া চাঁদপুরের মো. শফিকুর রহমান ব্যাপারী (৩০৬৭), সুলতান আহাম্মদ তপাদার (৩৯৫), মো. ইলিয়াস খান (৯০), ময়মনসিংহের নুর মোহাম্মদ মিয়া (৩১১৯), মরহুম ছোরহাব আলী (লাল মুক্তিবার্তা-১১৫১০০৩৩৪), দিনাজপুরের মো. লুৎফর রহমান (৩৯৪), রংপুরের শ্রী সুশীল চন্দ্র বর্মণ (১৩৯), কুমিল্লার সামছুল হক (৩১১৫), ঠাকুরগাঁওয়ের আবদুর রহমান (১৩২৭), নরসিংদীর মো. সিরাজুল ইসলাম (১৪৮৫), ফরিদপুরের সুনীল কুমার পাল (৩২২), নওগাঁর মো. আনিছুর রহমান (৯৩৬) এবং সাতক্ষীরার আ. মজিদ সানা (লাল মুক্তিবার্তা-০৪০৪০৫০২২০)। তাদের মধ্যে খন্দকার আবু জাফর সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপির সভাপতি। লিয়াকত আলী জাতীয় শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি শুক্কুর মাহামুদের ভাই।
১৫ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধাদের শুটিং প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জে যেসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, তাদের নিজ উদ্যোগে সনদ বাতিল করতে আহ্বান জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। অন্যথায় তাদের ‘পাকিস্তানিদের মতো ঘাড় ধরে বের করার’ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের ৩৪৭ জনের মধ্যে ১২ জনের সনদ বাতিলের বিষয়ে জামুকা সুপারিশ করলেও এখনও ঝুলে আছে ৩৩৫ জনের ভাগ্য। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নারায়ণগঞ্জ জেলা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার অ্যাডভোকেট নুরুল হুদা বলেন, নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি উপজেলায় সর্বমোট ৩৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে ১২ জনের বিষয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। এখনও বাকি ৩৩৫ জনের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা চাই যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হোক এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও শনাক্ত হোক।