পীর হাবিবুর রহমান :
দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতায়ই নয়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কারণে আজ বাংলাদেশে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বিকল্প কেবল শেখ হাসিনাই। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থননির্ভর নেতৃত্বের বেলায়ও শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে তিনিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নিজেকে নিজে অতিক্রম করা ছাড়া শেখ হাসিনার বিকল্প সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শিবিরেও নেই। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত পরিবার-পরিজনসহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ৩৯ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাই আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর ও তাঁর পিতার সব রাজনৈতিক উত্তরসূরি।
সব ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে দেশের অর্থনীতিকে পশ্চিমাদের কাছেও বিস্ময়কর জায়গায় নিয়ে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তোলার পরপরই হঠাৎ যেন চারদিকে নানামুখী ষড়যন্ত্রের গভীর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এক ধরনের গুমোট হাওয়া ও অস্থিরতা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একের পর এক গুজবে জনগণকে অশান্ত করে দিচ্ছে একটি অশুভ শক্তি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বারবার একটি গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দলের নেতা-কর্মী ও দেশবাসীকে সতর্ক করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এর পরও সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশ উন্নয়নে এগিয়ে যাবে। যেন তার মনোবল, প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তায় তিনি অবিচল।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্বাধীনতা-উত্তর থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বহু নীলনকশা এ দেশে প্রণীত হয়েছে, যার অনেকটি যেমন কার্যকর হয়েছে তেমনি অনেকটি ব্যর্থ হয়েছে। এসব ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে একেক সময় একেক ঘটনা ঘটেছে। কখনো দেশকে নেতৃত্বশূন্য করা হয়েছে, কখনো বা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দুর্বল করা হয়েছে। কখনো বা দেশের অর্থনীতির মেরুদ ভেঙে দিয়ে জাতিকে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির কোনো কর্মকা না থাকলেও পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে তাদের নৈশভোজ, চা চক্র নিয়মিতই হচ্ছে। এমনকি চাউর হয়েছে, পশ্চিমা কূটনীতিকরা এসব বৈঠকে আগামী ছয় মাস পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সবাইকে নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন এবং এক বছর পর একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের ফর্মুলা নিয়ে অগ্রসর হওয়া যায় কিনা এ প্রস্তাব নিয়ে কথা বলছেন। এ ক্ষেত্রে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সমর্থনও আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে বলে তারা মত রাখছেন। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও হেফাজতের সম্পর্ক রয়েছে।
একটি মহল যেন চাইছে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে বা তাঁকে কর্তৃত্বহীন করে সরকার সাজাতে। এমন লক্ষ্য নিয়েই কি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিল? এমন প্রশ্ন পর্যবেক্ষকদের। তবে পর্যবেক্ষক মহল থেকে রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অগণতান্ত্রিক অসাংবিধানিক শক্তির আগমন চলমান বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সুযোগ নেই। আর বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী অসাংবিধানিক শাসনের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সেই পথ রুদ্ধ করেছে। তাই পর্দার আড়ালে ওয়ান-ইলেভেনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কুশীলবরা তৎপর হলেও সুবিধা করার সুযোগ নেই।
এদিকে নানামুখী একের পর এক গুজব সমাজ জীবনকে অস্থির করে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টির, কখনো বা কৌশলে সরকারের ইমেজহানির চেষ্টা চলছে। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে মাঝখানে অগ্রসর বিজ্ঞানমনস্ক সমাজে গুজব ছড়িয়ে এতটাই হুলুস্থূল কা বাধিয়ে দেওয়া হলো যে, এ নিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষকে বিবৃতি পর্যন্ত দিতে হয়েছে। এরপর ছেলে ধরা গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে মায়েদের হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা শুরু হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে।
সরকারের অনেক মন্ত্রী-নেতা এমনকি ওপর মহলের সঙ্গে গভীর ঘনিষ্ঠতার সুবাদে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশাল সুবিধাভোগী অনেকের সঙ্গে প্রশাসনসহ বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও উদাসীন হয়ে পড়েছেন। ভাবখানা এমন, ক্ষমতায় থাকার দায়িত্ব পালন করবেন শেখ হাসিনা, চ্যালেঞ্জ নেবেন শেখ হাসিনা আর তারা তাদের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চেয়ারে আয়েশে দোল খাবেন। এদের একটা বড় অংশ যে ষড়যন্ত্রে নেই তার গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারবেন না। উপাচার্যকে ঘিরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্থিরতা, বুয়েটে আবরারের মতো মেধাবী সন্তানের নৃশংস হত্যাকা থেকে ফেনীর নুসরাত হত্যার রোমহর্ষক ঘটনাও খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দেখতে হয়। নুসরাত হত্যার দ্রুত বিচারে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আমজনতা সন্তোষ প্রকাশ করলেও, আবরার হত্যার বিচারও দ্রুতলয়ে অগ্রসর হওয়ায় দেশবাসী যখন স্বস্তিতে তখন পিয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সমাজে চরম অস্থিরতা তৈরি করেছে। সরকারের ইমেজে কড়া আঁচড় বসিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সময়মতো দায়িত্বশীলরা পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পিয়াজের মূল্য এতটা সীমাহীন হতো না। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এভাবে লাফালাফি করত না। সেই সঙ্গে মুনাফালোভী একটি সিন্ডিকেটও পিয়াজ মজুদ করায় দাম এতটা বেড়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেক বাইরে যাওয়া পিয়াজ গুদামে পচেছে। বাইরে ফেলা হয়েছে। কথা নেই বার্তা নেই দাম না বাড়লেও এবং কোনো ধরনের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ সারা দেশে লবণের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে বিদ্যুৎ গতিতে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করা হয়েছে। সবকিছুর নেপথ্যে মতলববাজ শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও মুনাফালোভীদের হাত রয়েছে, তেমনি সরকারবিরোধী গণঅসন্তোষ তৈরির ষড়যন্ত্রও চলছে। যেমন অনেকে মনে করেন, তেমনি অনেকে এটাকে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই দেখছেন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এসবের নেপথ্যে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিসহ নানা মহলের সেই তৎপরতা যার মাধ্যমে গোটা সমাজজুড়ে এমন অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা যায় যাতে সরকারের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ তীব্র হয়ে ওঠে। এতে অদৃশ্য অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রের দরজা উন্মুক্ত হয়। অনেকের আশঙ্কা, মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে দেশের আর্থিক খাতের সঙ্গে জড়িত বা অর্থনৈতিক লুটপাটের সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীরা এ ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকতে পারে। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের অনেক প্রভাবশালী যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সুযোগ সুবিধা ভোগ করে উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছেন তাদের হাতও থাকতে পারে। সেইসঙ্গে পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িতরা যেখানে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিগত নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুললেও কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মসূচি দিতে পারেনি বা আন্দোলন গড়ে তুলতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে তারাও এ ষড়যন্ত্রের জালে যুক্ত থাকতে পারে।
কসবায় ট্রেন দুর্ঘটনার পর স্বজনহারা মানুষের মাতম থামতে না থামতেই সিরাজগঞ্জে ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা- এ দুর্ঘটনা না ষড়যন্ত্রের নাশকতা সে প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলেছে। এমনকি বিগত নির্বাচনে দল-সমর্থকহীন নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ শক্তিতে বিজয়ী হয়ে দলীয় কোটায় নিজের স্ত্রীকেও সংসদে আনার এক বছর পর আওয়ামী লীগের অন্যতম শরিক ১৪ দলের নেতা রাশেদ খান মেননের ‘জনগণ ভোট দিতে পারেনি, আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নই’ হঠাৎ এমন বক্তব্য সহজে এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয় বলে অনেকে মনে করেন।
পর্যবেক্ষকদের মতে, রাশেদ খান মেনন একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হয়ে কোনো কারণ ছাড়া এমন বক্তব্য দিতে পারেন না। এটা রহস্যময়! একই সঙ্গে কিছু মন্ত্রীর অতিকথন বা এক মন্ত্রণালয়ের বিষয় নিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের বক্তব্যও বিতর্ক তৈরি করছে। এমনকি দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যারা আটক হয়েছেন, বিভিন্ন বেআইনি কর্মকাে র অপরাধে তাদের যারা ছায়া দিতেন দলের অভ্যন্তরে থাকা সেসব নেতার চলমান ভূমিকা কী তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। অনেকে বলছেন, বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থির-অশান্ত ও জনবিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যেসব গুজব-ষড়যন্ত্র ও তৎপরতা শুরু হয়েছিল সেই আলামত ইদানীং দেখা যাচ্ছে। পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে গভীরভাবে নজর রাখছেন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের অনেক দায়িত্বশীল পদে ব্যাপক ক্ষমতা নিয়ে যারা প্রধানমন্ত্রীর আশপাশ থেকে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে আছেন তারা আদর্শিকভাবে শেখ হাসিনার প্রতি কতটা অনুগত, বিশ্বস্ত ও আন্তরিক।
এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সড়ক পরিবহন আইন সরকার কার্যকর করতে না করতেই মানুষ যখন সড়কশৃঙ্খলায় আশাবাদী হয়ে উঠল তখন মালিক-শ্রমিকরা কোনো আলাপ-আলোচনা-দেনদরবার ছাড়াই দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়ে জনগণকে জিম্মি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। গণদুর্ভোগ চরমে নিচ্ছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, সামগ্রিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে, প্রয়োজনে কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে। অনেকের মতেই, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের তৎপরতা পরিকল্পিতভাবে শুরু করেছে এবং সেই তৎপরতার সঙ্গে সরকারের ওপর মহলে থাকার সুবাদে যারা বিপুল অর্থ লুটেছেন, প্রশাসনিক দাপট দেখিয়েছেন এবং অবৈধ উপায়ে বিদেশে অর্থ পাচার থেকে শুরু করে দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তারা এ ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দেশ যখন বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে সামনে অগ্রসর হচ্ছে তখন নানামুখী ষড়যন্ত্র ও তৎপরতা প্রধানমন্ত্রীকে সতর্কতার সঙ্গে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করার এখনই সময়।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ দেশে একদলীয় ব্যবস্থা, দীর্ঘ সামরিক শাসন, এমনকি তথাকথিত সুশীলদের সেনাসমর্থিত সরকারও ক্ষমতায় এসেছে। এর কোনোটাই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বিশেষ করে সামরিক শাসনামল জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসায় দেশ হরতাল-অবরোধ, সহিংস আন্দোলনে নিরন্তর অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। সেনাসমর্থিত সুশীল সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বিদায় নেওয়ার আগে অনভিজ্ঞ গণবিরোধী কর্মকাে র মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক শক্তি থেকে ব্যবসায়ী সমাজ এমনকি তাদের পরিবার-পরিজনকে যেভাবে অপমান-অপদস্থ ও দেশছাড়া করেছে, নয় কারাগারে পাঠিয়েছে; এতে তীব্র গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। মাঝখানে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোর করে যে অর্থ আদায় করা হয়েছিল, তা এখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের দোরগড়ায় এসে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভঙ্গুর হলেও চলমান মুজিবকন্যার শাসনকেই উত্তম বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
তাদের ভাষায়, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সফল হলেই, সুশাসন নিশ্চিত হলেই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কয়েক দফা বেড়ে যাবে। সরকারের ব্যবসাবান্ধব নীতি বেসরকারি খাতকে আরও সহযোগিতা দিলে, ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে। দেশের ব্যবসায়ী সমাজ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে দেশ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাতে ড. মাহাথিরের মালয়েশিয়া বা লি কুয়ানের সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এ ক্ষেত্রে চতুর্মুখী সব ষড়যন্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটন করে ষড়যন্ত্রকারীদের কালো হাত ভেঙে না দিলে একটা অনিশ্চিত অজানা আশঙ্কা নিয়ত তাড়া করে ফিরবে। কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা সব সময় উচ্চাভিলাষী ও চরম লোভী এবং স্বার্থপর হয়েই অঘটন ঘটায়। অতীত ইতিহাস তা-ই বলে।
শেখ হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে দুর্নীতির মামলায় দি ত হয়ে কারাজীবনই ভোগ করছেন না, নির্বাচনের যোগ্যতাও হারিয়েছেন। শারীরিকভাবে শেখ হাসিনা এখনো যতটা সক্ষম তাতে তাঁর সঙ্গে দৌড়ানোর শক্তিও এখন আর তাঁর নেই। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বহীনই নয়, শক্তিহীন অতিশয় দুর্বল নীরব দর্শকের সারিতে বসে গেছে। বিগত জাতীয় নির্বাচনে গণফোরাম সভাপতি সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেন ভোটযুদ্ধে বা আন্দোলনে কোনো ক্যারিশমা দেখাতে পারেননি। তিনি নিজেও প্রার্থী হননি। কারণ তাঁর দলের বা নিজের জনসমর্থন যেমন নেই, তেমনি বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীর শারীরিক অবস্থাও একেবারে কাহিল। দেশে যে সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক কোনো আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন বা গড়ে তুলবেন এমন শক্তি-সামর্থ্য তাঁর নেই। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার অভিজ্ঞতা, নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবিলার ইতিহাস ও প্রজ্ঞা নিয়ে শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশেই নয়, উপমহাদেশ ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক পোড় খাওয়া সফল রাষ্ট্রনায়ক। এমনকি অনেকে বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতেও তিনি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের দক্ষতায় রাজনীতির কূটকৌশলে নিজের নেতৃত্বকে সুসংহত করেছেন।
টানা তৃতীয়বারের মতো তিনি যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তখন দেশে আন্দোলন সংগ্রাম, হরতাল-অবরোধের ইতিহাস মুছে গেছে। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরেশোরে শুরু করেছেন এবং নিজের ঘর অর্থাৎ শাসক দল আওয়ামী লীগের বিতর্কিতদের পাকড়াও করার মধ্য দিয়েই সে অভিযান চালু রেখেছেন। দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের অনেক অঙ্গসহযোগী সংগঠনের বিতর্কিত নেতৃত্বকে অব্যাহতি দিয়ে সম্মেলনের মাধ্যমে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব নিয়ে আসছেন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও দলের শুদ্ধি অভিযান কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত চলবে বলে বারবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জোর দিয়ে বলছেন। এটা সফল হলে দলের জনপ্রিয়তাও বাড়বে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল যেখানে নেতৃত্বহীন অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে খোদ শাসক দল আওয়ামী লীগেও এমনকি তার শরিক মহাজোটেও শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে হাল ধরার মতো কোনো নেতৃত্ব নেই।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনার বিকল্প মানেই শেখ হাসিনা। আর তিনি সরে দাঁড়ালেই দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা, রক্তবন্যা, নৈরাজ্য, লুটপাট, সর্বস্তরে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়া এবং চরম অরাজকতার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিই নয়, সমাজ ও প্রশাসনের নানা শক্তির মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা স্তব্ধ হয়ে যাওয়াই নয়, একদম ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে দেশ পতিত হবে। দেশের অর্থনীতিরই সর্বনাশ হবে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি ঘটবে। সামাজিক নৈরাজ্য ও অরাজকতা চরম আকার নেবে। এ প্রেক্ষাপটে দৃঢ় নেতৃত্বের প্রাজ্ঞ-অভিজ্ঞ জনসমর্থিত ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের নিরিখে শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাকে ছাড়া আর কিছু চিন্তা করার সুযোগ নেই।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন