ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,ঢাকা প্রতিনিধি,১৩ অক্টোবর : বাড়ির মালিকদের আকর্ষন করার জন্য প্রথমেই হাতে ধরিয়ে দেন এক বা দুই বছরের আগাম বাড়ি ভাড়ার টাকা। ওই টাকা দেন চেকে। বাড়ির মালিকরা যখন সুমনের দেয়া চেক নিয়ে ব্যাংকে যান, তখন তার একাউন্টে কোনো টাকা পাওয়া যায় না। চেকটি ডিজঅনার হয়। পরে বাড়ির মালিক এসে চেক প্রত্যাখানে কথা বললে তাদের কিছু টাকা দিয়ে বাকি টাকা পরে দিবেন বলে আশ্বস্থ করেন। আর পরে টাকা চাইতে গেলেই বাধে ঝামেলা। এসবের একপর্যায়ে ভাড়া না দিয়ে বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে উল্টো ডাকাতি মামলাসহ নানা মামলায় জড়িয়ে দেন। খিলক্ষেত ও নিকুঞ্জ এলাকায় তার বাড়ি দখলের গল্পগুলো প্রায় একই রকম। এই এলাকায় প্রায় দশ থেকে বারোটি বাড়ি দখলে আছে কলেজটির এই কথিত এই চেয়াম্যানের কাছে।
তিনি বাড়ি ভাড়া নেন বেছে বেছে। বৃদ্ধ, নিরীহ, নিঃসন্তান বাড়ির মালিকদের টার্গেট করেন প্রথমে। তাও আবার চার পাঁচ তলার বাড়ির মালিক। এসব বাড়ির মালিকদের সবকিছু খোঁজখবর নিয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে যান আজিজুর রহমান সুমন। রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার রেসিডেন্সিয়াল ল্যাবরেটারি কলেজের চেয়ারম্যান হিসেবেই পরিচিত। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতারনায় নামেন সুমন। অভিযোগ রয়েছে বাড়ি ভাড়া নেয়ার প্রথম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন এই কলেজটিকে। বাড়ি ভাড়া নেন ওই কলেজের নামে, আবার কোনো বাড়ি ছাত্র বা ছাত্রীদের হোস্টেলের নামে।
খিলক্ষেত এলাকার এক বাড়ির মালিকের কাছ থেকে এমন অভিযোগ আসার পর অনুসন্ধানে নামেন এই প্রতিবেদক। অনুসন্ধানে মিলে সুমনের নানান প্রতারনার গল্প। সুমন শুধু বাড়ি দখল নয়, নানাভাবে হুমকি ধমকি হয়রানি করে মামলা দেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এসব বাড়ি দখলে নিয়ে সেখানে দেহ ব্যবসা থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা করেন এই প্রতারক। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়া নেয়া হয় রেসিডেন্সিয়াল ল্যাবরেটরি কলেজ ও হোস্টেলের নাম দিয়ে। এই চক্রটির হোতা আজিজুর রহমান সুমনের বিরুদ্ধে খিলক্ষেত ও নিকুঞ্জ এলাকায় বেশকটি মামলা ছাড়াও রয়েছে দশবারোটি সাধারণ ডায়েরি।
নিকুঞ্জ দুইয়ে দখলকৃত একটি বাড়ির মালিক পক্ষের স্বজন সৈয়দ আহাম্মেদ আলী বলেন, আমার মাম-মামী তার সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে থাকেন। সেই সুবাধে আমাদের কেউ থাকেন না এখানে। সুমন বাড়িটি ছাত্রী হোস্টেল করবে বলে ভাড়া নেন। কিন্তু প্রথম দুই একমাসের ভাড়া দিলেও পরের মাসে আর ভাড়া দেয়নি। ভাড়া চাইতে গেলেই খারাপ ব্যবহার করে। মামা মামীর অবর্তমানে বাড়িটি আমি দেখাশুনা করি। যার কারনে তার কাছে ভাড়া চাইতে যাই। কিন্তু সুমন ভাড়া না দিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে সে মামলা দিয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা শুধু আমার সাথে নয় এই এলাকার সাত থেকে আটটি বাড়ি দখল করে রেখেছে। সবার বিরুদ্ধেই থানায় মামলা দিয়েছে। থানাও বিষয়টি বুঝতে পেরে তার দেয়া আর মামলা নেয় না । কিন্তু সে এখন মামলা করে আদালতে।
আরেক ভোক্তভোগী সৈয়দ ইয়াসমিন জায়েদী বলেন, বাড়ি ভাড়া নেয়ার পর সুমন এখন আর আমাদেরকেই বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। সে আমাদের থেকে ভাড়া নিয়ে আমাদেরকেই বলছে ডাকাত। বাড়ির মালিক হয়েও আমরা বাড়িতে ঢুকতে পারব না। এখন সে ভাড়াও ঠিকভাবে দিচ্ছে না। বাড়িও ছাড়ছে না বলে অভিযোগ করেন এই ভুক্তভোগী।
এদিকে খিলক্ষেত এক নম্বর রোডের বাসাটিতে ভাড়ার টাকা চাইতে গেলে আশি বছর বয়সী বাড়ির মালিক বাদশা মিয়াকে মারধর করে সুমন। বাদশা মিয়াকে উদ্ধারের সময় পুলিশের ওপরও হামলা চালায় এই প্রতারক। পাওনা ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধের বদলে, আশি বছরের বৃদ্ধের নামে দেয়া হয় ডাকাতির মামলা। বাদশা মিয়া গনমাধ্যমকে বলেন, সুমনের কাছে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা পাওনা হলেও এখন সে টাকাও দিচ্ছে না উল্টো হয়রানি করছে আমাকে।
ভুক্তভোগী সৈয়দ জাফর জায়েদী বলেন, সে প্রথম থেকেই ভাড়া দিতে ঝামেলা করত। এরপর ভাড়ার জন্য বার বার তাগাদা দিলে সে উল্টো আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আজিজুর রহমান সুমনের এই প্রতারনা চক্রে রয়েছেন তার পরিবারের সদস্য ও কিছু চিহিৃত সন্ত্রাসী। মূলত আইনের ফাঁকফোকরকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন তারা।
এ ব্যাপারে খিলক্ষেত থানা বলছে , অনেক অভিযোগই তাদের কাছে এসেছে। তদন্ত করতে গিয়ে তাদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অনেকবার। খিলক্ষেত থানার ওসি (তদন্ত) আদিল হোসেন বলেন, সুমনের বিরুদ্ধে থানায় আট থেকে দশটি জিডি রয়েছে। এছাড়া পুলিশকে হেনস্থা করার মামলাসহ দু’টি মামলা আছে। তার জন্য থানায় দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তারাও অতিষ্ঠ। এমনকি পুলিশের ওপর হামলা করে উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই আইনি নোটিশ দেয় সুমন।
এদিকে থানায় যখন আর তার মামলা নেয়া হয় না তখনই সুমন মামলা করে সিএমএম কোর্টে । তবে বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়া সুমনের দায়ের করা মামলা আদালত খারিজ করে দেন। নারাজির পর তা তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভিস্টিগেশন (পিবিআই)। বর্তমানে তার মামলাটি তদন্ত করছে সংস্থাটি। তবে এই সংস্থাটি এই পর্যন্ত তার কোনো মামলার সত্যতা পায়নি।
পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার বলেন , সে এমন সব বাড়িগুলো টার্গেট করে যে বাড়িগুলোর শক্তিশালি কোনো ওয়ারিশ নেই। এরপর সে দীর্ঘদিন ভাড়া দেয় না। ভাড়া দিতে টালবাহানা করে। তবে তিনি বলেন মামলাটি তদন্ত কাজ এখনো চলছে।
বিষয়টি নিয়ে আজিজুর রহমান সুমনকে ফোন করলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দেন। বলেন পরে ফোন দিন। পরে ফোন করলে আর রিসিভ করেন না।