মিয়ানমারে সরকারি স্থাপনার জন্য রোহিঙ্গা গ্রাম ধ্বংস

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম,ঢাকা প্রতিনিধি,১০ সেপ্টেম্বর : মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পুরো গ্রাম গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পুলিশের ব্যারাক, সরকারি ভবন এবং শরণার্থী পুনর্বাসন শিবির। বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য।

মিয়ানমার সরকারের আয়োজিত এক সফরে গিয়ে বিবিসি অন্তত চারটি স্থান খুঁজে পেয়েছে যেখানে সুরক্ষিত স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। অথচ স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এগুলো আগে ছিল রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসতি।

তবে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গ্রামে এসব স্থাপনা তৈরির অভিযোগ নাকচ করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

২০১৭ সালে সামরিক অভিযানের জেরে সাত লাখের রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে যায়।

জাতিসংঘ একে জাতিগত নির্মূল কর্মকাণ্ডের ‘টেক্সটবুক’ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে নিজেদের বাহিনীর হাতে বড় মাত্রায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নাকচ করেছে মিয়ানমার।

মিয়ানমার, মূলত বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, সেনাবাহিনীর হাতে জাতিগত দমন এবং গণহত্যার অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে আসছে। তবে এখন তারা বলছে যে, তারা কিছু পরিমাণ শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত।

কিন্তু গত মাসে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের অনুমোদিত ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে কেউই ফিরতে না চাইলে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

তারা অভিযোগ তোলে যে, ২০১৭ সালে সংঘটিত নিপীড়নের জন্য কোন জবাবদিহিতা নেই এবং নিজেদের চলাফেরায় স্বাধীনতা ও নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়েও কোন নিশ্চয়তা নেই।

এই ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছে মিয়ানমার। তারা বলছে, তারা অনেক রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত ছিলো। এই বিষয়টি প্রমাণ করতেই বিবিসি-সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের তাদের প্রস্তুতি পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

সাধারণত রাখাইনে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিস্তর কড়াকড়ি রয়েছে। আমরা সরকারি গাড়ি বহরে ভ্রমণ করি এবং পুলিশের তত্ত্বাবধান ব্যতীত ছবি তোলা ও সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি আমাদের ছিল না।

তবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে উচ্ছেদের অকাট্য প্রমাণ দেখতে পাই আমরা।

স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট জানায়, ২০১৭ সালে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৪০ ভাগ গ্রাম পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

মিয়ানমারে কী দেখেছে বিবিসি?

মিয়ানমারের সরকার আমাদের হ্লা পো কং নামে একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারা দাবি করে যে, স্থায়ী আবাসে ফেরার আগে এই শিবিরটিতে ২৫ হাজার শরণার্থী দুই মাস ধরে থাকতে পারবে।

এই শিবিরটি এক বছর আগে তৈরি করা হয়েছিলো। তবে এখনো এর অবস্থা করুণ। এরইমধ্যে এর টয়লেটগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের সহিংসতায় ধ্বংস হওয় দুটি গ্রাম ‘হ রি তু লার’ এবং ‘থার হায় কোন’ নামে রোহিঙ্গা গ্রামেরউপর এই শিবিরটি তৈরি করা হয়েছে।

আমি যখন শিবিরটির পরিচালক সো শোয়ে অং-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে গ্রাম দুটো গুঁড়িয়ে দেয়া হল কেন, তখন কোন গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা অস্বীকার করলেন।

কিন্তু যখন আমি দেখালাম যে স্যাটেলাইট চিত্রে এর প্রমাণ রয়েছে, তখন তিনি বললেন যে, তিনি কয়েক দিন আগে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।

এরপর কিয়েন চং নামে আরেকটি পুনর্বাসন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। সেখানে জাপান এবং ভারত সরকারের সহায়তায় বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য।

তবে এই পুনর্বাসন শিবিরটি তৈরির জন্য মিয়ার জিন নামে একটি রোহিঙ্গা গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো। এই গ্রামটি ছিলো নতুন করে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা পুলিশ বাহিনীর জন্য বানানো একটি ব্যারাকের পাশে।

২০১৭ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর এই অংশটির বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিল রোহিঙ্গারা।

ক্যামেরার পেছনে মিয়ার জিন গ্রামটি গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেন কর্মকর্তারা ।

মংডু শহরের বাইরেই অবস্থিত মিও থু গাই নামে একটি গ্রামে একসময় ৮ হাজার রোহিঙ্গার বাস ছিল।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, আরেকটি সরকারি গাড়ি বহরে করে ভ্রমণের সময় ওই গ্রামটির ছবি তুলেছিলাম আমি। ওই গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু বড় দালানগুলো অক্ষত ছিল। আর যে গাছগুলো রোহিঙ্গা গ্রাম বেষ্টন করেছিলো সেগুলোও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলো।

কিন্তু এখন, মিও থু গাই গ্রামটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় বড় সরকারি স্থাপনা আর পুলিশ কমপ্লেক্স ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। এমনকি সেই গাছগুলোও নেই।

আমাদের ইন দিন নামে আরেকটি গ্রামেও নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ১০ জন বন্দী মুসলিম পুরুষকে হত্যাকাণ্ডের জন্য আলোচিত ওই গ্রামটি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অল্প যে কয়টি নির্যাতনের ঘটনা স্বীকার করে এটি তার একটি।

ইন দিন গ্রামের তিন-চতুর্থাংশ বাসিন্দাই ছিলো মুসলিম, বাকিরা রাখাইন বৌদ্ধ। এখন, মুসলিমদের কোন চিহ্ন নেই। রাখাইনরা চুপচাপ এবং শান্তিপূর্ণ।

কিন্তু যেখানে রোহিঙ্গারা থাকতো সেখানে গিয়ে দেখা গেলো যে, কোন গাছপালা নেই। তার পরিবর্তে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া আর বিশাল সীমান্ত রক্ষী পুলিশের ব্যারাক।

রাখাইনের বৌদ্ধ বাসিন্দারা বলছে যে, প্রতিবেশী হিসেবে মুসলিমদের আর কখনোই মেনে নেবে না তারা।

শরণার্থীদের জন্য এটা কী বার্তা দেয়?

২০১৭ সালের সামরিক বাহিনীর সহিংসতার অনেক দিন পরও চলমান ব্যাপক এই ধ্বংসযজ্ঞ ইঙ্গিত দেয় যে, খুব কম সংখ্যক রোহিঙ্গাই আসলে তাদের পূর্বের জীবনে ফিরতে পারবে।

বড় আকারে শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি হিসেবে একমাত্র হ্লা পো কং-য়ের মতো জরাজীর্ণ ট্রানজিট ক্যাম্প এবং কিয়েন চংয়ের মতো পুনর্বাসন শিবিরই দেখানো হচ্ছে।

তবে দু’বছর আগে শরণার্থীরা যে ধরণের মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গেছে তা থেকে খুব কম সংখ্যক শরণার্থীই বের হতে পেরেছে এবং তারা আসলে এ ধরণের ভবিষ্যতের আশা করেনি। এ বিষয়টি শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

ইয়াঙ্গুনে ফেরার পথে বাস্তুচ্যুত এক তরুণ রোহিঙ্গার সাথে দেখা হয় আমার। আমাদেরকে বলা হয়েছিল যে, অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবে না বিদেশি নাগরিকরা। সাত বছর ধরে একটি আইডিপি ক্যাম্পে নিজের পরিবারের সাথে আটকা পড়েছে ওই তরুণ।

২০১২ সালে সিত্তে এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার সাথে ঘর ছাড়া হয় সে।

কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেই তার। এমনকি অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ারও সুযোগ নেই।

বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে সে বলে, ঝুঁকি নিয়ে তারা যাতে বাংলাদেশে ফিরে না আসে। তাহলে তার মতো তারাও এ ধরণের ক্যাম্পে আটকে পড়বে।

সরকার কি বলছে?

রাখাইনে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে বক্তব্যের জন্য মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেনি সরকার।

সরকারিভাবে, বাংলাদেশের সাথে যৌথ সমন্বয়ের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সম্মত মিয়ানমার সরকার।

কিন্তু দেশটির মন্ত্রীরা এখনো রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালী’ বলে সম্বোধন করে থাকে। তাদের দাবি, গত ৭০ বছর ধরে অবৈধভাবে অভিবাসনের মাধ্যমে মিয়ানমারে গিয়েছে তারা। তবে এধরণের অভিবাসনের কোন ধরনের প্রমাণ নেই।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বাসিন্দা নয়, দেশটিতে প্রচলিত এমন বিশ্বাসের প্রতিফলনই এ ধরণের দাবির পেছনে কাজ করে।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের আবেদন খারিজ করেছে এবং চলাফেরায় স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তারা রোহিঙ্গাদের জাতীয় সনাক্তকরণ কার্ড বা ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড দিতে রাজি, এটা ক্রমান্বয়ে নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে উল্লেখ করে তারা।

কিন্তু বেশিরভাগ রোহিঙ্গা এটা নিতে অসম্মতি জানিয়েছে কারণ তাহলে তাদেরকে নিজেদের বাঙালী বলে স্বীকার করে নিতে হবে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে, রোহিঙ্গাদের উপর সামরিক নির্যাতন চলার সময়ে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেন, ১৯৪২ সালের ‘অসম্পন্ন কাজ’ সম্পন্ন করছেন তারা।

তিনি আসলে তৎকালীন রাখাইনে জাপানি ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ওই যুদ্ধে রোহিঙ্গা এবং রাখাইনের বৌদ্ধরা বিপরীত পক্ষকে সমর্থন করেছিলো।

সেসময়, তারা প্রায়ই একে অপরকে মারতো এবং যার কারণে বহু বেসামরিক মানুষ অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো।

সেনাপ্রধান বলেন, তখন রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে বন্যার স্রোতের মতো আসতে থাকে। যে এলাকাটি বর্তমানে বাংলাদেশের সাথে সীমান্তে অবস্থিত।

সীমান্তের মংডু এবং বুথিডং- এই দুটি জেলাই ছিলো মিয়ানমারে একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা। অবশ্য ২০১৭ সালের সহিংসতার সময় ওই দুটি জেলায় বেশিরভাগ গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের গণ-বাস্তুচ্যুতির পর থেকে ওই এলাকায় মুসলিমরা যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ ভাগ তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

সহিংসতার বিষয়ে তদন্তে সরকারের অনাগ্রহ, চলাফেরায় স্বাধীনতা না দেয়া বা নাগরিকত্ব অস্বীকারের মতো বিষয়গুলো শরণার্থীদের ফিরতে অনুৎসাহী করবে।

যার কারণে মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে যে ভারসাম্য রয়েছে তার কোন উন্নতি হবে না। যার অর্থ করা যেতে পারে সেই “অসমাপ্ত কাজ” হয়তো এতদিনে শেষ হয়েছে। বিবিসি