ধর্ষণে অভিযুক্ত ২ জনের মৃত্যু, গলায় চিরকুট- কে মারলো তাদের?

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.তম,পিরোজপুর প্রতিনিধি,২৮ জানুয়ারি : দশদিন আগে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে পিরোজপুরের একটি থানায় মামলা হয়েছিল। শনিবার দুপুরে পাশের উপজেলায় তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে।

মৃতদেহের গলায় বাধা একটি কাগজে লেখা, ”আমার নাম……মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ করার কারণে আমার এই পরিণতি।”

এর আগে গত ১৭ই তারিখে সাভারে আরেকটি ধর্ষণ মামলার আসামীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, যার গলাতেও একটি কাগজে লেখা ছিল, ”আমি ধর্ষণ মামলার মূল হোতা।”

উভয় ঘটনাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে তারা মারা গেছেন বলে পুলিশ জানালেও, কারা তাদের হত্যা করেছে – তা পুলিশ জানাতে পারেনি।

আসামী নিহত হওয়ার পরে ভয়ে পালাচ্ছেন বাদীরা

ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত একজনের মৃতদেহ পাওয়ার পর হামলার আশংকায় পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ভুক্তভোগী ছাত্রীর পরিবারটি।

অভিযোগ ওঠে, গত ১৪ই জানুয়ারি দুপুরে নানাবাড়ি যাবার পথে গণ ধর্ষণের শিকার হন পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানার একজন মাদ্রাসা ছাত্রী।

তিনদিন পরে ওই ছাত্রীর পিতা প্রতিবেশী এক কিশোর ও একজন যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ধর্ষণের মামলা করেন।

সেই মামলার নিহত যুবকের বাড়ি ছিল ওই ছাত্রীদের বাড়ির কাছেই।

ছাত্রীটির বাবা এবং মামলার বাদী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”নানাবাড়ি যাবার পথে আমার মেয়েকে ধর্ষণ করায় আমি দুইজনকে আসামী করে মামলা করেছি। তাদের একজনকে শনিবার মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বলে শুনেছি।”

“এরপরে তারা আমাদের সবাইকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, মারধরের চেষ্টা করছে। তারা নাকি আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবে বলেও বলছে।”

তিনি জানান, হামলার ভয়ে তাদের পরিবারের সবাই এখন অন্যত্র লুকিয়ে আছেন। পুলিশও তাদের নিরাপদে থাকতে বলেছে।

তবে নিহত যুবকের পরিবার ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন। তারা বলছেন, তাদের সন্তানকে হত্যার অভিযোগ এনে এখন ধর্ষণের অভিযোগ দায়েরকারীর বিরুদ্ধে মামলা করার পরিকল্পনা করছেন তারা।

নিহত যুবকের চাচা শাহিন জমাদ্দার বলছেন, ”আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোক ….তাকে মারেনি, তাহলে তাকে হত্যা করলো কে?”

“আমরা মনে করি পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ওরাই (ধর্ষণের অভিযোগ তোলা পরিবার) তাকে হত্যা করেছে। এখন আমরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।”

তিনি জানান, ঘটনার পরে ঢাকায় চলে এলেও বুধবার থেকে অভিযুক্ত যুবকটি নিখোঁজ ছিল। সেদিন কয়েক সেকেন্ড পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হলেও পরবর্তীতে আর কোন যোগাযোগ হয়নি।

মামলায় অভিযুক্ত আরেক কিশোরকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।

পুলিশ কী বলছে?

পুলিশ জানায়, ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানায়, ফলে সেই থানাতেও ওই ঘটনার তদন্ত চলছে।

ভাণ্ডারিয়া থানার ওসি মোঃ শাহাবুদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”গত ১৭ই জানুয়ারিতে আমাদের থানায় দুইজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। আমরা তদন্ত করেছি, কিন্তু অভিযুক্তরা পলাতক রয়েছে।”

“তবে জানতে পেরেছি, পাশের থানায় একজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। এর বেশি কিছু আমাদের জানা নেই।”

পার্শ্ববর্তী ঝালকাঠি থানার কাঁঠালিয়া থানার ওসি মোঃ এনামুল হক জানান, রাস্তার পাশে মৃতদেহ পড়ে থাকার খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে একজন যুবকের মৃতদেহ দেখতে পান, যার মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে।

“পরে আমরা সনাক্ত করি যে, তিনি পাশের ভাণ্ডারিয়া থানার একটি গণ ধর্ষণ মামলার আসামী।”

তার গলায় বাধা একটি কাগজে লেখা রয়েছে, ”আমার নাম……মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ করার কারণে আমার এই পরিণতি।”

কিন্তু কে বা কারা, কেন তাকে মেরেছে – সে বিষয়ে কোন তথ্য তারা জানতে পারেননি।

সাভার ও কাঁঠালিয়া হত্যাকাণ্ডের মিল

বাংলাদেশে কয়েকশো কিলোমিটার দূরের দুইটি উপজেলায় দশ দিনের ব্যবধানে দুইটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অনেক মিল দেখা গেছে।

দুইক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। নিহত হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকে তারা নিখোঁজ ছিলেন।

যে উপজেলায় ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে পাশের উপজেলায়। দুইটি মৃতদেহের গলায় ধর্ষণে স্বীকারোক্তিমূলক বার্তা ঝোলানো ছিল।

সাভারের ওসি মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, দশদিন আগের ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তারা নতুন আর কিছু জানতে পারেননি।

“কারা বা কেন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তার কোন তথ্য নেই আমাদের কাছে,” তিনি বলেন।

কোন বিশেষ গোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা সেরকম কোন তথ্য নেই পুলিশের দাবি। আবার এসব ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত কিনা, সেটিও তারা জানাতে পারছেন না।

কী মনে করছেন বিশ্লেষকরা

ঘটনার ধরণ দেখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই আঙ্গুল তুলতে চান মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষক নূর খান লিটন।

নূর খান লিটন বলছেন, ”প্রথম কথা হচ্ছে যে, যখন আমাদের এখানে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখন দেখা যেতো যে শুধু মৃতদেহ পাওয়া যেতো, কিন্তু আর কোন তথ্য পাওয়া যেতো না। পরে দেখা যেতো সেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করেছে।”

“নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, এ ধরণের অনেক ঘটনায় তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে।”

সাভারের ধর্ষণ মামলার অভিযুক্তের মৃত্যু এবং গলায় লেখা কাগজের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর কার্যকলাপ অনেক সময় সমাজে ভীতি তৈরি করতে সহায়তা করে। যেমন বিভিন্ন ক্রসফায়ারের ঘটনায় তাদের কাছ থেকে একই ধরণের বক্তব্য পাওয়া গেছে।

”সাভার ও কাঁঠালিয়ার এই ঘটনায় একধরণের মিল পাওয়া গেছে। তাই অনেকে ধারণা করছেন এ ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা থেকে থাকতে পারে, যদিও সেটার প্রমাণ এখনো নেই,” তিনি বলেন।

তবে দেশের কয়েকটি এলাকায় এর আগে বেশ কয়েকটি ধর্ষণ মামলার আসামীদের পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা দেখা গিয়েছিল।

গতবছরের এপ্রিলে কক্সবাজারে ও মে মাসে সাতক্ষীরায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুক-যুদ্ধে শিশু ধর্ষণ মামলার দুই আসামি নিহত হন। এর আগে ২০১৪ সালে উত্তরায় নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যা করে একজন কলেজ ছাত্রী অপহরণ ও ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামী ডিবির সঙ্গে “বন্দুক যুদ্ধে” নিহত হন।

বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে, বাংলাদেশ বছরে একহাজারের বেশি নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।