ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,ষ্টাফ রিপোর্টার,২৪ মে : মাদকবিরোধী ব্যাপক অভিযান শুরুর পর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধুবাদ জানানো হলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন, ‘কেবল চুনোপুঁটি নয়, মাদকের গডফাদারদের দ্রুত আইনের আওতায় নিতে হবে। তাদের ছাড় দেওয়া হলে অভিযানের মূল লক্ষ্যই ব্যর্থ হবে।’ তবে পুলিশ-র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তারা সমকালকে জানান, মাদকের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। মাদকের গডফাদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদক ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তির পেশা বা পরিচয় দেখা হবে না। এই মরণনেশা নিয়ে যারা বাণিজ্য করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কোনো শৈথিল্য বা কৃপা দেখানোর সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তারা। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, চলমান অভিযান মাদকের বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ ঘোষণার শামিল। এ অভিযানে মাদক-সংশ্নিষ্টদের কঠোর বার্তা দিতে চান তারা, যাতে কেউ মাদক ব্যবসা ও সেবনে জড়িত থাকার সাহস না দেখান।
চলমান অভিযানে এখনও মাদকের গডফাদার পর্যায়ের তেমন কোনো ব্যক্তি পুলিশ-র্যাবের গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েননি। মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে দেশব্যাপী পরিচিত এমন কারও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। যারা ধরা পড়ছেন বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হচ্ছেন, তারা স্থানীয় পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী। যারা নেপথ্যে থেকে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাদের গ্রেফতার করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় নেওয়া গেলে জনগণের কাছে মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে আরও ইতিবাচক সাড়া মিলবে।
সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সর্বশেষ গত রোববার গণভবনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করা হয়েছে, তেমনি মাদক থেকেও দেশকে উদ্ধার করা হবে।
মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে পুলিশ-র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বুধবার পর্যন্ত ৪২ জন নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় নিহত হয়েছেন আটজন। অতীতে দেশে বিভিন্ন সময় মাদকবিরোধী অভিযান হলেও ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এত নিহত হওয়ার নজির নেই।
খুলনায় এক অনুষ্ঠানে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সব গোয়েন্দা বাহিনী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিয়েছে। কারা মাদকের সঙ্গে জড়িত, কারা মাদকের ব্যবসা করেন। আমরা তাদের বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করছি। আমাদের কাছে যে তালিকা রয়েছে, সে অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনী তাদের খুঁজছে। কাউকে আমরা ক্রসফায়ারে দিই না। যখন চ্যালেঞ্জ করা হয়, তখনই নিরাপত্তা বাহিনী নিজেদের রক্ষা করতে গুলি করতে বাধ্য হয়। এ ঘটনায় আমাদের পুলিশ সদস্য, র?্যাবের সদস্যও আহত হচ্ছেন।
র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সমকালকে বলেন, মাদকের সঙ্গে জড়িত যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে। সে গডফাদার হোক বা অন্য কেউ। মাদকের বিরুদ্ধে জড়িতদের ব্যাপারে আইনের মধ্যে থেকেই সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সমকালকে বলেন, মাদকের সঙ্গে কারা জড়িত, কারা সেখানে অর্থলগ্নি করেছে, কারা বাসা ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছে তাদের তালিকা অচিরেই প্রকাশ করা হবে। মাদকের যারা গডফাদার, আইনের আওতায় নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করার আহ্বান জানানো হবে।
সংশ্নিষ্টদের বক্তব্য হচ্ছে ইয়াবা এখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে ফেনসিডিলের রমরমা ব্যবসা। অভিযোগ আছে, অনেক জায়গায় মাদক ব্যবসার সঙ্গে পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু সদস্য সরাসরি মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ত। বিভিন্ন সময় পুলিশের অভ্যন্তরীণ আলোচনায়ও উঠে এসেছে পুলিশের সঙ্গে মাদকের সংশ্নিষ্টতা। মাদক ব্যবসার সঙ্গে পুলিশের সংশ্রব দূর করতে হলে আগে পুলিশের নিয়োগ থেকে শুরু করে বদলিবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বিভিন্ন সময় অসাধু পুলিশ সদস্যরা আটকও হয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শুধু বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৬৩ লাখ ৯ হাজার ৩৬০ পিস ইয়াবা বড়ি জব্দ করে। এ ছাড়া একই সময়ে তারা এক লাখ ৩৫ হাজার ২২৬ বোতল ফেনসিডিল আটক করে। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় র্যাব-পুলিশ সারাদেশে অভিযান চালিয়ে আড়াই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ও সেবীকে গ্রেফতার করে। ৪ মে থেকে র্যাবের মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হন দুই হাজার ৭৬৪ জন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে সারাদেশে প্রতিদিন শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হচ্ছেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের গডফাদারদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তারা কোথা থেকে মাদক পান, বিক্রিতে কারা সহায়তা করেন বা স্থানীয় কোনো প্রভাবশালীকে মাসোয়ারা দিতে হয় কি-না সেসব বিষয়ে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রভাবশালী কেউ থাকলে তাদের দিকেও নজরদারি করা হচ্ছে। এসব প্রভাবশালীকে সব তথ্যপ্রমাণ হাতে নিয়েই আইনের আওতায় নেওয়া হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশ সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে তৈরি মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় বেশ কয়েকজন গডফাদারের নাম উঠে এসেছে। এসব তালিকা এখন হালনাগাদ করা হচ্ছে। জোরেশোরেই খোঁজ নেওয়া হচ্ছে আগের তালিকায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাদক ব্যবসায় রয়েছেন কি-না বা তারা মাদক ব্যবসায় সহায়তা করেন কি-না। তাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সংস্থা তথ্য অনুসন্ধান করছে। প্রমাণ মিললেও এসব প্রভাবশালীকেও ছাড় দেওয়া হবে না।
সূত্র বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই মাদক বহনে জড়িতদের আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে মাদকের চিহ্নিত আখড়াগুলোও ধ্বংস করা হচ্ছে। চলমান অভিযানে মাদক বিশেষ করে ইয়াবার পাইকারি বিক্রেতাদের টার্গেট করে কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে ইয়াবার অনেক পাইকারি ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় নেওয়া হয়েছে। অভিযানের মধ্যে গোলাগুলিতে অনেকে নিহতও হয়েছেন। এরপরই মাদকের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সে অনুযায়ী এখন ‘হোম ওয়ার্ক’ চলছে। এসব প্রভাবশালী গডফাদারের বিষয়ে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পৃথক তালিকা রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এসব তালিকা যাচাই করে সমন্বয় করা হচ্ছে।
ইয়াবার গডফাদারের তালিকায় শতাধিক নাম :সূত্রগুলো বলছে, মাদকের গডফাদার বা হোতাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল’ রয়েছেন। তারা মূলত অন্য কাজের আড়ালে মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
তবে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে সর্বত্রই আলোচনায় কক্সবাজারের স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদির নাম। তার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে কখনও মুখ খোলেনি। বিভিন্ন সময়ে সংস্থাগুলোর করা মাদকের গডফাদারদের তালিকায় দেখা যায় ঘুরেফিরে আবদুর রহমান বদির পরিবারের লোকজনের নামও এসেছে। এ ছাড়া গডফাদারের তালিকায় টেকনাফের ফয়সাল, সফিক, আল আমিন, আবদুস শুক্কুর, টেকনাফ পৌরসভার বাসিন্দা সাহেদুর রহমান, মুজিবুর রহমান, আকতার ও শাহেদ, কামরুল হাসান, মারুফ, সাইফুল করিম, আবুল কালাম, নুরুল হুদা, জাফর আহমেদ, নুরুল আমিন, শামসুল আলম, দিদার মিয়া, মোস্তাক, আজিজসহ কক্সবাজার এলাকার অন্তত ৬০ জন রয়েছেন এই তালিকায়। এ ছাড়া ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ইয়াবার গডফাদার হিসেবে কড়াইল বস্তির বাবা কাসেম; গেন্ডারিয়ার রবিন, রহিমা বেগম; গুলশান এলাকার সালাউদ্দিন ও রাজু, বাড্ডার পিচ্চি মোশাররফ, খিলক্ষেতের নাজমা ইসলাম, নিউমার্কেট এলাকার আসমা আহমেদ ডালিয়া, নাছির উদ্দিন; ভাসানটেকের জামাল সরদার, উত্তরার মহসিন, মিরপুরের জাহানারা বেগম, খিলগাঁওয়ের নূর মোহাম্মদ ও সাফিয়া আক্তার শোভা; পল্টনের ইফতেখার জামান জয়, লালবাগের মহসিন আজাদ, কাঁঠালবাগানের জাহিদ ওরফে টাইগার বাবুর নাম রয়েছে। এ ছাড়া গডফাদার ও তাদের সহযোগীদের তালিকায় বেশ কয়েকজন ওয়ার্ড নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নামও রয়েছে। সর্বশেষ ডিএমপি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে তৈরি করা পৃথক প্রতিবেদনে রাজধানীতে মাদকের ৮২ গডফাদারের নাম উঠে আসে। সেখানে তিন পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকার দলীয় ৮ নেতার নাম রয়েছে। তিন পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- বনানী থানার এসআই আবু তাহের ভুইয়া, পল্লবী থানার এসআই বিল্লাল ও মাজেদ। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দেন ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি জামাল মোস্তফার ছেলে রুবেল, সবুজবাগের ওহাব কলোনির স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা ওরফে বাবরী মোস্তফা, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পল্টন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা জামান পপি।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজকে বলেন, সারাদেশেই তাদের হাতে জেলাভিত্তিক মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা থাকে। এসব তালিকায় বিক্রেতা, বহনকারী এবং তাদের আশ্রয়দাতা গডফাদারদের নামও থাকে। সময়ের পরিবর্তনে এসব তালিকা হালনাগাদ করে নতুনভাবে অভিযানও চালানো হচ্ছে।