ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,২১ ফেব্রুয়ারি : বদলে যাচ্ছে পাবলিক পরীক্ষার বর্তমান পদ্ধতি। আগামীতে ছাপানো প্রশ্নপত্রে আর পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মুদ্রিত প্রশ্নপত্রের বদলে প্রতিটি স্তরের প্রতিটি বিষয়ের পরীক্ষার জন্য ‘প্রশ্নব্যাংক’ তৈরি করা হবে।
বিশেষ একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে র্যানডম সিলেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষার দিন সকালে চূড়ান্ত প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। এরপর পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টা আগে সকাল সাড়ে ৯টায় আগে ওই ডিভাইস ব্যবহার করে কেন্দ্র সচিবদের প্রশ্ন জানিয়ে দেওয়া হবে। তিনি পরীক্ষা কক্ষের বোর্ডে তা লিখে জানিয়ে দেবেন। এর পর পরীক্ষা নেওয়া হবে। আগামী এসএসসি থেকে তুলে দেওয়া হবে এমসিকিউ প্রশ্নপত্র।
মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দুই ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে শিগগিরই শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, অভিভাবকসহ সবার সমন্বয়ে বড় একটি সেমিনার আয়োজন করে সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করা হবে।
মঙ্গলবারের এ সভায় সরকারের তিনজন মন্ত্রী, ছয়জন সচিবসহ ১৮টি সরকারি দপ্তরের প্রধানরা অংশ নেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে সভায় অংশ নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।
সভা সূত্রে জানা গেছে, আগামী পরীক্ষা গ্রহণের পদ্ধতিই আমূল বদলে ফেলা হবে। পরীক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জড়িত লোকজনের সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে পুরো পদ্ধতিকে ডিজিটালাইজ করা হবে। পাবলিক পরীক্ষায় আর আগামীতে প্রশ্নপত্র ছাপানো হবে না। ডিজিটাল ‘প্রশ্নব্যাংকে’র মাধ্যমে যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষার দিন সকালে অটোমেটিক প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে।
পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রশ্ন সেট ও পাসওয়ার্ড জানিয়ে দেওয়া হবে। পরীক্ষার হলে কেন্দ্র সচিবদের একটি করে ডিজিটাল ডিভাইস দেওয়া হবে। সকাল সাড়ে ৯টার পর তাতে পাসওয়ার্ড প্রবেশ করানো হলে প্রশ্নপত্র ভেসে উঠবে। তা দেখেই পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষকরা বোর্ডে প্রশ্ন লিখে দেবেন।
পরীক্ষার কক্ষ বড় হলে প্রয়োজনে কক্ষজুড়ে একাধিক বোর্ড ব্যবহার করা হবে, যেন পেছনের পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন দেখতে কোনো সমস্যা না হয়। এভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে। প্রশ্নব্যাংকে সারাবছর শিক্ষকরা প্রশ্ন পাঠাতে পারবেন। হাজার হাজার প্রশ্ন এ ব্যাংকে জমা করা হবে। পরীক্ষার দিন তা থেকে নির্ধারিত ১০টি প্রশ্ন যন্ত্রের সাহায্যে বাছাই করে চূড়ান্ত করা হবে। কোন প্রশ্নটি চূড়ান্ত করা হলো, তা সকাল সাড়ে ৯টার আগে কেউ দেখতে পারবে না।
সংশ্নিষ্ট ডিভাইসে নির্ধারিত সময়ের পরে পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেই কেবল কেন্দ্র সচিবরা প্রশ্ন জানতে পারবেন। এখনকার মতোই পরীক্ষার্থীদের আধঘণ্টা আগে কেন্দ্রে গিয়ে আসন গ্রহণ করতে হবে। এমসিকিউ প্রশ্নপত্র তুলে দেওয়া হবে। তবে নতুন পদ্ধতি কার্যকর করার আগে আগে পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) ‘ডামি পরীক্ষা’ নেওয়া হবে।
সভা সূত্র জানায়, বর্তমান পরীক্ষা ব্যবস্থায় সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী পরীক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন। এত বিশালসংখ্যক মানুষের সম্পৃক্ততায় পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব নয়।
সভায় আরও আলোচনা হয়, এইচএসসি পরীক্ষা আগামী ২ এপ্রিল দেশজুড়ে শুরু হচ্ছে। এরই মধ্যে এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়ে গেছে। তাই নতুন পদ্ধতি এ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও কার্যকর করা সম্ভব নয়। প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এই নতুন পদ্ধতি আগামী বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সভা শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহবার হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া এখন আছে, সে পদ্ধতিতে কোনোভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো সম্ভব হবে না। আগামীতে আর প্রশ্নপত্র ছাপানোই হবে না। সভায় সকলে একমত হয়েছেন, অনলাইন প্রশ্নব্যাংকের মাধ্যমে আগামীতে পরীক্ষা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, সভায় অনেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তবে এসএসসিতে সারাদেশে সাড়ে তিন হাজার পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। জেএসসিতে আরও বেশি। এর মধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায়ও অনেক পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই; যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা। সেসব কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নিতে গেলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তখন মহাকেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। এসব সংকটের কথা ভেবে পরীক্ষার হলে কেন্দ্র সচিবদের, এমনকি সম্ভব হলে পরীক্ষার্থীদের একটি করে ডিভাইস (ট্যাব) দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। এ ডিভাইসে নির্দিষ্ট সময়ে অটোমেটিক প্রশ্ন ভেসে উঠবে, তা দেখে পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সেমিনার করা হবে।
তিনি আরও বলেন, নতুন এই পদ্ধতি চালু করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আগামী এসএসসি পরীক্ষায় নতুন পদ্ধতি চালু করা হবে।
জানা গেছে, সভার শুরুতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেকের হাতে একটি কার্যপত্র তুলে দেওয়া হয়। এতে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে কয়েক দফা সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব ছিল, সনাতনী পদ্ধতির প্রশ্নপত্র প্রণয়ন বাদ দিয়ে প্রশ্নব্যাংক তৈরি করা। সেখানে বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় থেকে প্রশ্ন করা হবে। ২০/৩০টি বা এর চেয়ে বেশি মানসম্মত প্রশ্ন সেট তৈরি করা হবে।
চলমান পরীক্ষার বিষয়ে সাংবাদিকদের সচিব আরও বলেন, ‘আগামীতে যেসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে কোনো কর্মকর্তা, শিক্ষক বা কর্মচারীকে হাতে মোবাইল নিয়ে পরীক্ষা হলের ত্রিসীমানার মধ্যে পাওয়া গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কোনো ব্যক্তির মোবাইলে পাওয়া গেলে তাকে আইসিটি আইনের আওতায় বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।’
গত তিন দিন থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ন্ত্রণে এসেছে জানিয়ে সোহরাব হোসাইন বলেন, আগামী পরীক্ষাগুলো আরও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৫২টি মামলা হয়েছে, ১৫২ জনকে আটক করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
এমসিকিউ বাতিলের বিষয়ে সচিব বলেন, এমসিকিউ বাতিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছেন, তা আমাদের জন্য নির্দেশ। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বন্ধ করতে হয়, সেই প্রক্রিয়ায় আমাদের যেতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টায় এ সমন্বয় সভা শুরু হয়। বিকেল পৌনে ৬টায় শেষ হয়। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর, বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ, মাউশির মহাপরিচালক প্রফেসর মো. মাহাবুবুর রহমান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা।