পাঁচ দিনব্যাপী ব্যাংকিং মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মাননীয় সভাপতি ও সাবেক সফল খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, আজকের অনুষ্ঠানের সম্মানীয় সভাপতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মুহাঃ রাজী হাসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য ডেপুটি গভর্নরবৃন্দ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আমার সহকর্মীবৃন্দ, মেলার প্রধান সমন্বয়কারী বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল ও তাঁর টিম, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীগণ, অন্যান্য সহযোগী সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ, অন্য অতিথিবৃন্দ, গণমাধ্যমের নিরলস সংবাদ কর্মীগণ এবং মেলায় আগত সর্বস্তরের মানুষ Ñ সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভসন্ধ্যা।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আয়োজিত পাঁচ দিনব্যাপী এই ব্যাংকিং মেলা শুরুর আগে অনেকের মধ্যেই কী হতে যাচ্ছে, কেন এই মেলা, আদৌ মেলা করা সম্ভব হবে কিনা এ ধরনের অনেক প্রশ্ন চিহ্ন ছিল। ছিল সংশয়, উৎকণ্ঠাও। বলতে দ্বিধা নেই, সকল প্রশ্ন ও উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে আজ অত্যন্ত সফলভাবেই মেলাটি শেষ হতে যাচ্ছে। যথেষ্ট সাড়া পেয়েছি আমরা। তাই হেমন্তের এই সন্ধ্যায় আমি সত্যিই খুবই আনন্দিত, মুগ্ধ ও গর্বিত। এজন্য আমি মেলা আয়োজনের প্রধান সমন্বয়কারী বিরূপাক্ষ পাল ও তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঝাঁক উদ্যমী ও তরুণ কর্মকর্তা, আর্থিক খাত ও অন্যান্য সংস্থার সংশ্লিষ্টদের বিশেষ অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাতে চাই। এই মেলাটি ছিল আর্থিক খাতের আমাদের সবার কাজের এক সম্মিলিত স্বীকৃতি। সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ না নিলে কোনো কর্মপরিকল্পনাই সফল হয় না Ñ আজ সেটি আবারও প্রমাণিত হলো।
একটি ব্যাংকিং জাতি গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে আমরা মেলাটি আয়োজন করেছিলাম তা যেন আজ সত্যিই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলো। শুধুমাত্র আর্থিক খাতের সেবা ও পণ্যের প্রচার, এসব পণ্য ও সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ধারণা দেওয়া এবং দেশের সব মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার মূল উদ্দেশ্যের মধ্যেই মেলাটি সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং গত পাঁচটি দিন আর্থিক খাতের কর্মী, সেবাভোগী, সেবাপ্রত্যাশী ও সাধারণ মানুষের পদচারণায় বাংলা একাডেমি হয়ে ওঠেছিল এক মিলন মেলায়। ব্যাংকাররা যে শুধু নিত্যদিনের পরিশ্রমী মানুষই নয়, তাদের মনেও যে রসকষ আছে, তাদেরও যে বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে তা এই মেলার মাধ্যমে অনেকটাই অনুধাবন করা গেছে। আমি শুনেছি, প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় আমাদেও ব্যাংকার ভাই-বোনেরা দারুণ পারফর্ম করেছে। উপভোগও করেছে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তাই এবারের আয়োজনটিই যেন শেষ না নয়। আপনারা রাজি থাকলে বছরের এই সময় বা বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রতিবছর ব্যাংকিং মেলা আয়োজন করতে চাই। আপনারা সবাই রাজি আছেন তো?
আমি জানতে পেরেছি, আমাদের ব্যাংকিং জীবনের ইতিহাসÑঘনিষ্ঠ এই মেলায় ছিল দেশে কার্যরত সকল তফসিলি ব্যাংক, একটি বিশেষায়িত ব্যাংক, বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো মিলে আশিটির মতো স্টল ছিল। ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের দশ-বারটি বিভাগের স্টল। এসব স্টল থেকেই আর্থিক পণ্য ও সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ধারণা দেওয়া হয়েছে। জবাব দেওয়া হয়েছে তাদের নানা জিজ্ঞাসার। আমানত, ঋণ ও বিনিয়োগ সম্পর্কেও মানুষ সম্যক ধারণা নিয়েছেন। এক জায়গায় সকল ব্যাংক ও সকল সেবা পেয়ে মানুষ উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এছাড়া, ছিল প্রতিদিনের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ সেমিনার Ñ যেখানে ব্যাংকিং খাত ও এর বাইরের জ্ঞানী-গুণী মানুষের কথা ও গঠনমূলক আলোচনা আমরা শুনেছি ও রেকর্ড করেছি। ছিল নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রাণবন্তু বিতর্ক প্রতিযোগিতা Ñ যেখানে সমসাময়িক ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে তারুণ্যের উচ্ছ্বল যুক্তিতর্ক শুনেছি। তরুণ তার্কিকরা স্বাধীনভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পেয়েছে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রশ্নোত্তর পর্বের উন্মুক্ত আয়োজন Ñ যেখানে গ্রাহকদের মুখোমুখি অবস্থানে ছিল দশ-বারটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী। এই গ্রাহকগণের বেশিরভাগেরই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর সাথে আগে কখনো কথা বলা দূরের কথা তাদেরকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্যও তাদের হয়নি। মেলার মাধ্যমে তারা সেই সুবর্ণ সুযোগটি পেয়েছেন। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের তারা সরাসরি প্রশ্নবানে আক্রান্ত করেতে পেরেছেন তাদের সমস্যা, অভিযোগ ও দাবী-দাওয়া নিয়ে। অন্যদিকে, প্রধান নির্বাহীগণও বুঝতে পেরেছেন সাধারণ গ্রাহকদের দুর্ভোগের কথা। এই সভাটিতে আমিও উপস্থিত ছিলাম। আরো ছিল আর্থিক শিক্ষা বিষয়ক নানা আয়োজন এবং বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত ‘সুবর্ণভূমি’ নামে সংকলনটি ছিল ব্যাংকিং জগতের একটি চিন্তাচর্চার প্রতিফলন। সংকলনটিতে অংশগ্রহণকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিত ও তাদের সেবা-পণ্য তুলে ধরা হয়েছে Ñ যা আগ্রহী গ্রাহক ও পাঠকদের উপকারে আসবে। এককথায়, মেলার সব আয়োজনই মানুষকে মুগ্ধ করেছে, আনন্দ দিয়েছে ও ব্যাংকিং সেবা দিয়েছে বলে আমি মনে করি।
দেশের অর্থনীতিকে আরো বেগবান করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য আমরা নিত্যদিনের আর্থিক সেবা ও পণ্য সহজে পৌঁছে দিতে চাই সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। এই মেলা আমাদের সেই অক্লান্ত নিত্যদিনের সেবার কথা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে জাতির সামনে। ব্যাংক যে শুধু ধনিদের জন্য নয়, এটি সকল মানুষের জন্য Ñ তা তুলে ধরা হয়েছে এই মেলায়। ব্যাংকগুলোও আজ শিখতে পেরেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য বিত্তবানদের পাশাপাশি বিত্তহীনদের মাথার ওপরও ছাতা খুলে ধরা উচিৎ। মানুষ জানতে পেরেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে তাদের আর্থিক উন্নতির একনিষ্ঠ বন্ধু। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই মেলা মানুষের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মেলার বার্তা দেশ-বিদেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীগণ এই পাঁচদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আমি মিডিয়া সেইসব ভাই-বোনদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
গত ছয়-সাত বছর ধরে বিচক্ষণ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও আর্থিক খাত তত্ত্বাবধান কাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তনের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতকে কাজে লাগিয়ে আমরা দেশের গরিব, অসহায়, বঞ্চিতদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে কৃষি, খুদে, মাঝারি, নারী উদ্যোক্তা ও পরিবেশবান্ধব খাতে অর্থায়ন বাড়ানো হয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষদের আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আজ কৃষক ও অসহায় মানুষ, গার্মেন্টস শ্রমিক, স্কুলের ছাত্রছাত্রী, কর্মজীবী পথশিশুরা দশ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলতে পারছে। অথচ একসময় ব্যাংক ছিল তাদের কাছে সোনার হরিণ। দেশের সব মানুষ আজ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলে দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা পাঠাতে ও লেনদেন করতে পারছে। ছাত্রছাত্রীরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফি জমা দিতে পারছে। ব্যাংকের হিসেবও খুলতে পারছে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে ‘ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা’ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সিএসআর, গ্রিন ব্যাংকিং, সিএসআর, এজেন্ট ব্যাংকিং, আর্থিক শিক্ষার মতো সামাজিক দায়বোধ প্রণোদিত ও জনবান্ধব নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে ‘১৬২৩৬’ হটলাইনযুক্ত গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এতোদিনে আজ মনে হচ্ছে, ব্যাংকিং খাতকে একটি মানবিক ও জনবান্ধব আর্থিক খাতে পরিণত করতে পেরেছি। অর্থনীতিও এর সুফল পাচ্ছে। এই সময়ে আমাদের সব সূচকেই স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উন্নয়নমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকা-ে দেশে আর্থিক খাতের সুস্থিতি ও রেজিলিয়েন্স বেড়েছে। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী মন্দা ও দেশীয় চ্যালেঞ্জের মুখেও বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বেশ সাফল্যের ধারাতেই রয়েছে। আমাদের এসব সাফল্যের গল্পই তুলে ধরা হয়েছে এই ব্যাংকিং মেলায়। তাই আসুন, একটি সুস্থির, সুশৃঙ্খল আর্থিক খাতের পাশাপাশি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জাতীয় লক্ষ্যার্জনে আমাদের যে পথচলা শুরু হয়েছে, সেই সুদূরপ্রসারী পথে আমরা একসাথে, এক লয়ে হাঁটি। সবাই মিলে একযোগে হাঁটলে আমরা অনেক দূর যেতে পারব। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়া। জাতির পিতার সেই স্বপ্ন পূরণে চলুন আমরা একযোগে, এক মনে জোরকদমে হাঁটতে থাকি। এই ব্যাংকিং মেলা সেই প্রেরণার উৎস হয়ে থাকুক।
পরিশেষে, শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও আমাদের আজকের সমাপনী অনুষ্ঠানে সময় দেওয়ায় আমি প্রধান অতিথি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আর এই সুষ্ঠু, সুন্দর ও সফল মেলা আয়োজনে যারা এতোদিন রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তাদের সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ ও অভিনন্দন এবং উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবারের ব্যাংকিং মেলার এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করছি।
সবাই ভালো থাকুন।