ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১০ অক্টোবর : রমনা থানার পূর্বপার্শ্বে, ইস্কাটন গার্ডেন রোড থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণে কাকরাইল পর্যন্ত এই পুরো এলাকাটি সরকারি জমি। এখানে বেসরকারি কোনও ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে কোনও জমি বা প্লট বরাদ্দ বা লিজ দেয়া হয়নি একমাত্র ডাক্তার আব্দুল বাসিত ছাড়া। ডাক্তার আব্দুল বাসিত ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। সেই সুবাদে ১৯৫৬ সালে তাকে ২৫ কাঠা আয়তনের একটি প্লট লিজ দেয়া হয়েছিল বিশেষ বিবেচনায় এবং বিশেষ শর্তে। জমিটি দেয়া হয়েছিল ৩০ বছরের জন্য। আব্দুল বাসিত মারা যাওয়ার পর তার কোনও উত্তরাধিকারী ছিল না। তিনি জীবিত থাকতেই লিজের মেয়াদ অনেক আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। উত্তরাধিকারী না থাকায় লিজ নবায়নের জন্য আবেদনও করেননি আব্দুল বাসিত। ফলে দীর্ঘদিন জমিটি সেই অবস্থায়ই ছিল। কিন্তু অবশেষে এই জমির উপর চোখ পড়ে বোরাক রিয়েল এস্টেট মালিকের। আব্দুল বাসিতের এক ভাতিজাকে দাঁড় করিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাক ডেটে তার নামে মৌখিক দানপত্র তৈরি করা হয়। তাকে মালিক সাজিয়ে ভুয়া কাগজপত্রে জমিটি হাতিয়ে নেয়া হয়। সেই জমিতেই গড়ে উঠেছে দেশের অন্যতম সুউচ্চ ভবন ‘ইউনিক হাইটস’।
জানা গেছে, ডা. আবদুল বাসিত, পিতা মৃত আলহাজ্ব মৌলভী মফিজউদ্দিন আহমেদ বরাবর তার বসবাসের জন্য ২০ নম্বর ময়মনসিংহ রোড হোল্ডিংভুক্ত সম্পত্তি ১৯৫৬ সালের ২৮ মে শর্তসাপেক্ষে নামমাত্র মূল্যে দেয়া হয়। তৎকালীন ঢাকার জেলা প্রশাসক ৩০ বছরের জন্য ২৫ কাঠা বা ০.৪১২৫ একর খাস জমির এই লিজ দলিল করেন। সাবেক খতিয়ানভুক্ত সাবেক ১৯ ও ২০ নম্বর দাগভুক্ত এই জমিটি ৫৯১৬ নম্বর রেজিস্ট্রিকৃত লিজ দলিলমূলে লিজ দেয়া হয়।
শুধু এই প্লটটি ছাড়া এর আশেপাশে সবগুলো জমিই এখনো সরকারের মালিকানায়ই রয়েছে। এই প্লটটি তখন বিশেষ বিবেচনায় এবং বিশেষ শর্তে ডা. আব্দুল বাসিতকে বসবাসের জন্য দেয়া হয়েছিল। লিজের রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে বলা হয়েছে, নি¤œ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি কিংবা উহার কোন অংশ কোন প্রকার হস্তান্তর করা যাবে না। এছাড়া বলা হয়েছে, নি¤œ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি যে উদ্দেশ্যে লিজ দেওয়া হয়েছে সেই উদ্দেশ্য ব্যতিত অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। লিজকৃত সম্পত্তি লিজদাতা অর্থাৎ সরকার প্রয়োজনে যে কোনও সময় ফেরত নিতে পারবে এবং লিজ গ্রহীতা উক্ত সম্পত্তির মালিকানা ও দখল হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকবেন। অন্যথায় লিজদাতা অর্থাৎ সরকার লিজ গ্রহীতাকে উচ্ছেদ করে সম্পত্তির দখল গ্রহণ করতে পারবে।
অথচ বোরাক রিয়েল এস্টেট এই সম্পত্তিতে ‘ইউনিক হাইটস’ নামে ২০ তলাবিশিষ্ট সুউচ্চ ভবন নির্মাণের সময় যেসব কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ১৯৮১ সালের ১৬ মার্চ ডা. আব্দুল বাসিত লিজ সম্পত্তি তার স্ত্রী বেগম সুফিয়া বাসিত ও ভাতিজা (ভাইয়ের ছেলে) মোহাম্মদ ইকরামকে (প্রত্যেককে সাড়ে ১২ কাঠা করে মোট ২৫ কাঠা) দান করেছেন। কিন্তু, এই দানপত্র রেজিস্ট্রিকৃত ছিল না। তিনি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে এই দানপত্রের ঘোষণা দেন, যা মৌখিক দানপত্র নামে পরিচিত। এখানে তিনটি অনিয়ম হয়েছে, প্রথমত: লিজ দলিলের শর্ত এতে ভঙ্গ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এইটি রিজিস্ট্রিকৃত দানপত্র ছিল না। আসলেই ওই সময় এই সম্পত্তি দান করা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তৃতীয়ত: সরকারের আইনানুযায়ী ভাতিজাকে সম্পত্তি দান করা যায় না।
বর্তমানে যারা এই সম্পত্তির মালিকানা দাবি করছেন তাদের কাগজপত্রে আরও দেখা যায়, ডা. আব্দুল বাসিতের স্ত্রী বেগম সুফিয়া বাসিত মারা গেছেন ১৯৮৭ সালের ২০ জুলাই। আব্দুল বাসিত ইতিপূর্বে তার যে এই লিজ সম্পত্তির অর্ধেক (সাড়ে ১২ কাঠা) বেগম সুফিয়া বাসিতকে দান করেছিলেন সেটি সুফিয়া বাসিত মারা যাওয়ার আগে নোটারি পাবলিক অর্থাৎ মোখিক দানপত্রের মাধ্যমে ১৫ মার্চ, ১৯৮৬ পুনরায় স্বামী আব্দুল বাসিতকে দান করেন। আব্দুল বাসিত সেটি আবার নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ভাতিজা মোহাম্মদ ইকরামকে দান করেছেন ১৭ মার্চ ১৯৮৮ সালে। মোহাম্মদ ইকরাম এভাবেই পুরো লিজ সম্পত্তির (২৫ কাঠা) মালিক হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। এবং মোহাম্মদ ইকরাম ডেভেলপার হিসেবে বোরাক রিয়াল এস্টেটকে এই সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন। তাতে গড়ে উঠেছে ২০ তলা বিশিষ্ট সুউচ্চ এই কমার্শিয়াল ভবন ‘ইউনিক হাইটস’।
এক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, জমিটি লিজ দেয়া হয়েছিল ৩০ বছরের জন্য, যার মেয়াদ ১৯৮৬ সালেই শেষ হয়েছে। লিজের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ইতিমধ্যে আরও ৩১ বছর পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত লিজ নবায়নের জন্য কেউ আবেদনও করেননি। তাছাড়া এ ধরনের আবেদনের এখন আর সুযোগও নেই। কারণ, লিজ গ্রহণকারী বর্তমানে জীবিত নেই। তার বৈধ কোনও উত্তরাধিকারীও নেই। মোহাম্মদ ইকরাম বরাবরে এখন যে দানপত্র দেখানো হচ্ছে তা রেজিস্টিকৃত নয়। নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে দানের যেসব কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে তা বস্তুত ভুয়া বা ফেইক বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন। দানপত্র সঠিক হলেও মোহাম্মদ ইকরাম কোনোভাবেই এক্ষেত্রে সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। এর কারণ, দানপত্র সংক্রান্ত সরকারের যে আইন রয়েছে তাতে বলা হয়েছে দানপত্র মোট ৮ জনের মধ্যে করা যায়। এরা হলেন বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন। মোহাম্মদ ইকরাম লিজ গ্রহীতা ডা. আব্দুল বাসিতের সম্পর্কে ভাতিজা। যেহেতু মোহাম্মদ ইকরাম এই ৮ জনের মধ্যে নন, কাজেই তিনি এ দানপত্র পেতে পারেন না। এছাড়া যেসব শর্তে জমিটি লিজ দেয়া হয়েছিল তা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এসব কারণে জমিটির লিজের কার্যকারিতা এখন নেই। এ জমির সম্পূর্ণ মালিকানা এখন সরকারের। অথচ সরকারি এই জমিতে ‘ইউনিক হাইট’ নামে বহুতল ভবন নির্মাণ করে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রির চেষ্টা চলছে। এরসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়েরও একটি চক্র জড়িত। তাই জরুরিভিত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে এই জমিটির দখল নেয়া উচিত বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন।