ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,১৩ আগস্ট : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। ভয়াবহ সেই দিনটির কথা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে। জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায় সেদিনের ভয়াবহতার চিত্র। জানা যায় ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িটির ভেতরে-বাইরে। সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে চ্যানেল আই অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বাদশ পর্ব।
প্রসিকিউশনের ৪২নং সাক্ষী মেজর জিয়া উদ্দিন আদালতকে জানান, তিনি সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি একজন ব্যবসায়ী। মুক্তিযুদ্ধের পরে কুমিল্লায় ৩ ফিল্ড আর্টিলারিতে লেঃ পদে যোগদান করেন। মেজর আজিজ পাশা এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মেজর পাশা ক্যাপ্টেন হুদার ভগ্নিপতি ছিলো। তখন মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন হুদা কুমিল্লায় ১ ফিল্ড আর্টিলারিতে ছিলো। ঘটনার সময় তিনি ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন।
ঘটনার কিছুদিন আগে মেজর ডালিম, মেজর নুরসহ আরো কিছু অফিসারের সরকারের বিরুদ্ধে করা একটি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ডিজিএফআই এর ডিজি ব্রিগেডিয়ার রউফ একটি চিঠি দিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান। এরপর তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রোগ্রাম পান। ডিজিএফআই থেকে তাকে বঙ্গবন্ধুর পার্সোনাল বডিগার্ড হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু যেখানে যাবেন সেখানে সাদা পোশাকের সৈনিকদের পোস্টিং-এর দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। ১২-১৩ আগস্ট তিনি এই সব জায়গাগুলি পরিদর্শন করে সৈনিকদের যথাস্থানে পোস্টিং-এর পরিকল্পনা করেন। ১৪ই আগস্ট দুপুর বেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায় কয়েকটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তিনি ৩-৪ জন সৈনিক নিয়ে ঘটনাস্থলে যান এবং বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করেন।
পরের দিনের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি আদালতকে বলেন, ১৫ই আগস্ট ভোর ৫.৩০ মিনিটে তিনি গুলশানের ডিজিএফআই অফিসার মেস থেকে জীপে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাত্রা করেন। পথে মহাখালী রাস্তার আইল্যান্ডের উপরে একটি ট্যাংক এবং রাস্তার পার্শ্বে খাদে আরেকটি ট্যাংক দেখতে পান। ওই ২টা ট্যাংকের পাশে ক্রুরা ছিল। বর্তমান যাদুঘরের মোড়ে এলে ডিজিএফআই এর একজন সৈনিক দৌড়ে এসে তার গাড়ি থামিয়ে বলে, স্যার শেখ সাহেবকে তো মেরে ফেলেছে এবং মেজর ডালিম রেডিওতে এই ঘোষণা প্রচার করছে। পাশেই পানের দোকান থেকে একটি ট্রানজিস্টার নিয়ে তাকে ঘোষণা শোনায়। ঘটনার সত্যতা যাচাই এর জন্য তিনি রেডিও সেন্টারে গিয়ে একটি ঘরে মেজর ডালিমকে দেখেন। মেজর ডালিম উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বলছে ‘গুষ্টিসুদ্ধা মেরে ফেলেছি।’ তিনি রেডিও সেন্টারের চত্বরে কিছু নিরস্ত্র রক্ষী বাহিনীর সদস্যকে দেখেন। সেখান থেকে ডিজিএফআই অফিসে গিয়ে ডিজি ব্রিগেডিয়ার রউফ সাহেবকে রেডিও সেন্টারসহ তার দেখা সমস্ত বিষয়ে বিবরণ দেন এবং ডিজিকে সেনা সদরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি কিছুক্ষণ পরে সেনা সদরে যান। সেখানে জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফসহ সিনিয়র অফিসারদেরকে দেখেন। আরো দেখেন যে জেনারেল শফিউল্লাহর পিছনে স্টেনগান হাতে মেজর ডালিম দাঁড়িয়ে আছে।
সেখানে অন্যান্য অফিসারদের কাছে শুনতে পান, মেজর ডালিম সশস্ত্র অবস্থায় লাথি মেরে আর্মি চিফের দরজা খুলে জেনারেল শফিউল্লাহকে বের করে আনেন। পরে অস্ত্রের মুখে ইস্ট বেঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। মেজর জিয়াউর রহমানসহ অন্যান্য অফিসার তাকে অনুসরণ করে। মেজর ডালিমের জীপে একটি মেশিনগান ফিট করা ছিল। কিছুক্ষণ পর মেজর ডালিম স্কট করে জেনারেল শফিউল্লাহকে রেডিও সেন্টারে নিয়ে যায়। পিছনে জেনারেল জিয়াউর রহমান, এয়ার ও নেভি প্রধান যায়। এদিকে যেহেতু বঙ্গবন্ধু ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন, তাই কোন পদক্ষেপ নিলে গৃহযুদ্ধ ও অযথা রক্তক্ষয় হতে পারে এমন ভেবে কোন পদক্ষেপ নেওয়া সমীচীন নয় বলে আলোচনা হয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ রক্ষী বাহিনীর ডাইরেক্টর হাসানকে রেডিও সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে নির্দেশ দিলে তিনি তা পালন করে ডাইরেক্টর হাসানকে রেডিও সেন্টারে নিয়ে যান।
রক্ষী বাহিনীর হেড-কোয়ার্টারে রক্ষী বাহিনীর সদস্যদেরকে battle dress এ দেখতে পান। পরে রেডিও সেন্টারে খন্দকার মোস্তাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম, মেজর রশিদ, মেজর নুর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর মহিউদ্দিন(ল্যান্সার), মেজর রাশেদ চৌধুরীকে দেখেন। কিছুক্ষণ পর মেজর ফারুক ও কর্ণেল তাহের আসেন। মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে আলাপ করে। কর্ণেল তাহের উত্তেজিত এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করে মেজর রশিদ ও মেজর ফারুককে বলেন, তোমরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছ কেন? এই বলে রাগান্বিত অবস্থায় কর্ণেল তাহের রেডিও সেন্টার ত্যাগ করেন। তিনি ডিজিএফআই অফিসে ফিরে যান। কর্ণেল মুসিউদ্দৌল্লাহ ও কর্ণেল মাহমুদুল হাসানকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির হত্যাকাণ্ডের ছবি তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনিও তাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে মেজর নুর, মেজর হুদাকে দেখেন। তখন বেলা ১১টা হবে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গ্যারেজে করিডোরে একটি গাড়ির মধ্যে বুলেটবিদ্ধ কর্ণেল জামিলের লাশ দেখেন। নিচে রিসেপশন রুমে শেখ কামাল, শেখ নাসের ও অপর একজনের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখেন। ডিজিএফআই এর ক্যামেরা দিয়ে নিচতলায় লাশের ছবি তোলেন।
তারপর উপর তলায় লাশগুলির ছবি তোলার জন্য সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠেই সিঁড়ির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখে তারা থমকে দাঁড়ান। সেখানে বঙ্গবন্ধুর লাশের ছবি তোলেন। তখন দোতলার করিডোরে আর্টিলারি ও ল্যান্সারের সৈনিক পাহারারত ছিল। বঙ্গবন্ধুর শয়ন কক্ষে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামালের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশের ছবি তোলেন। বাড়ির ভিতরে বাইরে বিভিন্ন দেয়ালে অসংখ্য বুলেট আর রক্তের চিহ্ন দেখেন। বাড়ির ভিতর ও বাইরে বুলেটের খোসা ইতস্ততঃ ছড়ানো দেখেন। আসবাবপত্র তছনছ অবস্থায় দেখেন। পরে ফিরে এসে ছবিগুলি ডিজিএফআই অফিসে ফেরত দেন।
এরপরের ঘটনা বর্ণনা করে জিয়া উদ্দিন বলেন, তারপর ওই দিন বিকালে ডিজিএফআই এর পক্ষ থেকে বঙ্গভবনে যান। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির রুমে বসে খন্দকার মোস্তাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ, এয়ার চিফ এ কে খন্দকার, নেভি চিফ এম এইচ খান মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর নুর, মেজর মহিউদ্দিন(ল্যান্সার), মেজর আজিজ পাশাকে আলাপ-আলোচনা করতে দেখেন। কিছুক্ষণ পর দেখেন মেজর ফারুক বঙ্গভবনে কয়েকটি ট্যাংক মোতায়েন করাচ্ছেন।
৪৪নং সাক্ষী কর্নেল সাফায়েত জামিল
প্রসিকিউশনের ৪৪নং সাক্ষী কর্ণেল সাফায়েত জামিল বলেন, ঘটনার সময় তিনি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ১, ২, ৪, ১৬ ৪টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন(বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ২ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট এবং ৬টি সাপোর্টিং ও স্যার্ভিল্যান্স কোম্পানি ছিল। ১, ২, ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ২-ফিল্ড আর্টিলারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছিল। লেঃ কর্ণেল মতিয়ুর রহমান ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের, লেঃ কর্ণেল আজিজুর রহমান ২ বেঙ্গল রেজিমেন্টের, লেঃ কর্ণেল আমিনুল হক ৪র্থ রেজিমেন্টের এবং লেঃ কর্ণেল চৌধুরী খালেকুজ্জামান ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ঘটনার সময় মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ২-ফিল্ড আর্টিলারি কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ঘটনার আগে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। ঘটনার ৬-৭ মাস আগে এই রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।
ঘটনার সময় লেঃ কর্ণেল মোমিন ছুটিতে থাকার কারণে টু আই সি মেজর ফারুক ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারে ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার ছিলো। ঘটনার আগে ৪৬ ব্রিগেড থেকে ফিল্ড ইনটেলিজ্যান্স সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে পাকিস্তান থেকে রিপ্যাট্রিয়েটের অফিসার আসা শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের পদোন্নতি, বদলি ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। পাশাপাশি রক্ষীবাহিনীর সুযোগ-সুবিধা, সরঞ্জাম বাছাই নিয়ে নানারকম অপপ্রচার চলতে থাকে। এই সময় অস্ত্রউদ্ধার অভিযানে মেজর শরিফুল হক ডালিম পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে লাঞ্ছিত ও নাজেহাল করে। পারিবারিক কলহের জের হিসেবে মেজর ডালিম একজন সহযোগী অফিসার ও কিছু সেনা সদস্যসহ গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে ও তার পরিবারকে লাঞ্ছিত করে। মেজর ডালিমের এই উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপের দরুন তাকে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর জের ধরে সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে মেজর নুর। তখন মেজর নুরকেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মেজর ডালিম ও মেজর নুর পরস্পরের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। চাকরিচ্যুতির কারণে তারা দুজনেই বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং তার সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল।
মেজর ফারুক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় তাকে ২ বছরের সিনিয়রিটি দেওয়া হয়নি। সেজন্য তিনিও বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ ছিল। মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক পরস্পরের ভায়রা ছিল। সেনাবাহিনীতে দুই ইউনিটে একত্রে বা লাইফ এমিউনিশন নিয়ে নাইট ট্রেনিংয়ের বিধান ছিল। ১৫ই আগস্ট সকাল প্রায় ৬টার দিকে তার বাড়ির দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কার আওয়াজ শুনে দরজা খুলে মেজর রশিদকে স্টেনগান কাঁধে দেখেন। তার সাথে নিরস্ত্র ব্রিগেড মেজর হাফিজ এবং আর্মি হেড কোয়ার্টারের অফিসার লেঃ কর্ণেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী ছিলেন। তাকে দেখা মাত্র মেজর রশিদ বলেন We have captured state power under Khandaker Mostaque. Shaikh is killed. do not try to take an action against us. একথা শুনে কর্নেল সাফায়েত জামিল হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান।
সেই মুহূর্তে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করে ‘বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করেছে তা জানি কিনা?’ জবাবে বলেন ‘না’। মেজর রশিদের কাছ থেকে পাওয়া খবরে তাকে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর জানান। তখন জেনারেল শফিউল্লাহ বলে, বঙ্গবন্ধু তাকে(শফিউল্লাহ) টেলিফোনে জানিয়েছেন যে, আক্রমণকারীরা সম্ভবতঃ শেখ কামালকে মেরে ফেলেছে। জেনারেল শফিউল্লাহ টেলিফোনে আলাপ করে তার ৩ কমান্ডিং অফিসারকে ব্যাটালিয়ন তৈরি করার নির্দেশ দেন। তারপর বৈঠকখানায় গিয়ে মেজর হাফিজকে পান। কিন্তু মেজর রশিদ ও লেঃ কর্নেল আলী আহম্মেদ চৌধুরীকে পায় না। তিনি দ্রুত ইউনিফরম পরে মেজর হাফিজসহ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দেন। পথিমধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে তাকে সেভরত অবস্থায় পান। তার কাছ থেকে ঘটনা শোনার পর জেনারেল জিয়া বললেন, প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো হোয়াট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার।
সেখান থেকে বের হয়ে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ ঢোকার মুখে একটি ট্যাংককে আক্রমণাত্মক অবস্থায় দেখেন। ট্যাংকের উপর মেজর ফারুক বসা ছিল। মেজর ফারুক তার সাপ্লাই ও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সারিবদ্ধ গাড়িগুলির উপর হেভি মেশিনগান দিয়ে ফায়ার করে। ফলে কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আরো বেশ কয়েকজন আহত হয়। ১ম বেঙ্গল ইউনিটের লাইনের ভিতরের রাস্তার উপর আরো ৩টি ট্যাংক আক্রমণাত্মক অবস্থায় দাঁড়ানো দেখের। তাৎক্ষণিকভাবে ওই ট্যাংকগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যাওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে সিজিএম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে আসে। তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফের বরাত দিয়ে ৪৬ ব্রিগেডের যাবতীয় অপারেশন্যাল কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবেন বলে জানান।
সকাল প্রায় ৮টার দিকে মেজর ডালিম ইউনিফরম ও সশস্ত্র অবস্থায় একটি জীপে হেভি মেশিনগান ফিট করে কয়েকজন সশস্ত্র সেনাসহ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। পিছনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও আরো কয়েকজন অফিসার ছিলেন। কিছুক্ষণ পর বিমান বাহিনী প্রধান এ কে খন্দকার ও নৌবাহিনীর প্রধান এম এইচ খান ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে আসেন। কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর জেনারেল শফিউল্লাকে মেজর ডালিম সশস্ত্র অবস্থায় রেডিও সেন্টারে নিয়ে যায়। তাদের পিছনে বিমান ও নেভি প্রধান রেডিও সেন্টারে যায়। কিছুক্ষণ পর ৩ বাহিনী প্রধান, পুলিশ প্রধান ও রক্ষীবাহিনী প্রধানের আনুগত্য ঘোষণা রেডিওতে শোনেন।
এরপরের ঘটনাক্রম বর্ণনা করে সাফায়েত জামিল আদালতকে বলেন, তারা সারাদিন ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে ছিলেন। সন্ধ্যার দিকে বঙ্গভবন থেকে প্রত্যাবর্তনকারী অফিসারদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, খন্দকার মোস্তাকের চক্রান্তে ও নেতৃত্বে মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর শাহরিয়া, মেজর শরিফুল হোসেন, মেজর মহিউদ্দিন(আর্টিলারি), মেজর মহিউদ্দিন(ল্যান্সার), মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর আজিজ পাশা, মেজর হুদা, রিসালদার সারোয়ার, রিসালদার মোসলেম এদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে আক্রমণ করে পরিবারসহ তাকে ও অন্যান্যদেরকে, সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আক্রমণ করে পরিবারসহ তাকে ও অন্যান্যদেরকে এবং শেখ মনির বাড়িতে আক্রমণ করে স্ত্রীসহ তাকে হত্যা করে এবং অবৈধভাবে খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। আরো জানতে পারেন ১৫ই আগস্ট সকাল বেলা মেজর ডালিম কতিপয় সশস্ত্র সেনাসহ জীপের উপর হেভি মেশিনগান ফিট করে হেড কোয়ার্টার থেকে অস্ত্রের মুখে জেনারেল শফিউল্লাহকে ১ম বেঙ্গল ইউনিটে নিয়ে আসেন।
আরো জানতে পারেন মেজর মহিউদ্দিন(আর্টিলারি) বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণ করার সময় কয়েকটি ফিল্ড আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করে। লক্ষ্যভ্রষ্ট ওই গোলা মোহাম্মদপুরের সিভিল এলাকায় পড়ে কয়েকজন সিভিলিয়ান হতাহত হয়। এই ঘটনায় কর্নেল জামিল ও কর্তব্যরত কিছু সেনা সদস্য হতাহত হয়। আরো জানতে পারেন চক্রান্তকারী সেনা অফিসার ও তাদের সেনা দলসহ ১৪ই আগস্ট দিবাগত গভীর রাতে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট লাইনে জমায়েত হয়। সেখানে মেজর ফারুক তাদেরকে ব্রিফিং দেয় এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে হত্যার অপারেশনে যায়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ সতীর্থ ছিলেন। জিয়াউর রহমান সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তাকে চিফ অব আর্মি স্টাফের পদ দেওয়া হয়নি। সেই কারণে ২ জনের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল না। ১৯ শে আগস্ট সেনা হেড কোয়ার্টারে ঢাকার সিনিয়র আর্মি অফিসারদের একটি মিটিং হয় সেই মিটিং-এ খন্দকার মোস্তাকের নির্দেশে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ উপস্থিত থাকে। তাদেরকে লক্ষ্য করে বলে, You people are mutoners, deserters and killers. You must brought back to the chain of command and tried for crime. এই কথা শুনে তারা বাক্যহীন হয়ে পড়ে এবং বিষণ্ন মুখে বসে থাকে।
মেজর রশিদ, মেজর ফারুক সার্বক্ষণিকভাবে বঙ্গভবনে অবস্থান করত। তাদের সঙ্গী অন্যান্য সহযোগী অফিসাররা রেডিও সেন্টারে অবস্থান করে সার্বক্ষণিক নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে একটি অলিখিত Revolutionary command council গঠন করে খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সরকার পরিচালনা করছিল। ২৪ শে আগস্ট জেনারেল শফিউল্লাহকে অবসর দেওয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়। জেনারেল খলিলুর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ করা হয়। ব্রিগেডিয়ার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট ডিফেন্স অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয়।
জেনারেল জিয়া চিফ অব আর্মি স্টাফ হয়ে সেনাবাহিনীকে চেইন অব কমান্ডে ফিরিয়ে আনার কোন চেষ্টাই করেনি। ফলে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর একটি অভ্যুত্থান অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। ১৫ই আগস্টের হত্যাকারী অফিসারদের চেইন অব কমান্ডে ফিরিয়ে আনার জন্য ৩রা নভেম্বর সিজিএস খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে তারা একটি সেনা অভ্যুত্থান ঘটান। ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার বাদে অন্য সব ইউনিট তাদের সাথে ছিল। এই অভ্যুত্থানের নেগোসিয়েশনের এক পর্যায়ে ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসার মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর পাশা, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন(ল্যান্সার), ক্যাপ্টেন মাজেদ, কর্নেল শাহরিয়ার, রিসালদার সারোয়ার, রিসালদার মোসলেম কিছু পরিবারসহ খন্দকার মোস্তাক এর উদ্যোগে ২রা নভেম্বর রাতে দেশ ত্যাগ করে চলে যায়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ৭ই নভেম্বর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ১৫ই আগস্ট ও ৩রা নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদেরকে বৈদেশিক মিশনগুলিতে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করে। মেজর রশিদ, মেজর ফারুক চাকরি নেননি। ১৯৭৬ সালে তারা উভয়েই বাংলাদেশে ফিরে আসে। মেজর ফারুক সাভার এবং বগুড়াতে বিদ্রোহ ঘটাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মেজর রশিদ ২-ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব গ্রহণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। জেনারেল জিয়া তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আবারও তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে ১৫ আগস্টের ঘটনাকারী অফিসাররা জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান ঘটাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আবার তারা সবাই চাকরিচ্যুত হয় এবং বিদেশেই ফেরারী জীবন-যাপন করতে থাকে। হোসাইন মোঃ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে তাদেরকে দ্বিতীয়বার পুনর্বাসন করে এবং সমস্ত বকেয়া বেতন দেয়। সেই থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সকল সরকারের আমলে তারা আনুগত্য লাভ করে।