পুলিশের কেনাকাটায় ৪শ’ কোটি টাকার দুর্নীতি!

SHARE

untitled-6_314194শরীফুল ইসলাম ও ফসিহ উদ্দীন মাহতাব : পুলিশের কেনাকাটায় বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নজরে আসার পর নির্দেশ অনুসারে একজন যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। কিন্তু কমিটির সদস্য হিসেবে পুলিশের একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নাম পুলিশ সদর দপ্তর এক মাসেও না দেওয়ায় কমিটি কাজ শুরু করতে পারেনি। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত একটি কমিটি তদন্ত শুরু করেছে এবং তা মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

অভিযোগ অনুসারে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাটির সদস্যদের পোশাক, জুতা, হেলমেট, ট্রাফিক বাতি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি দামে কেনা হয়েছে। নামমাত্র দরপত্র আহ্বান করে নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয় করে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করা হয়েছে। এর সঙ্গে পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত বলে অভিযোগ।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটিকে ১৪ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইলিয়াস হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয়েছিল।

জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক ফরিদ আহমেদ পুলিশের কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার বিষয় স্বীকার করে বলেন, এটি তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কার্যক্রম শুরু করবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করবে। পরে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অভিযোগ পাওয়া গেলে সব

অভিযোগ যে সত্য হবে সেটি ভাবা ঠিক নয়।

এক মাস আগে কমিটি করা হলেও তারা কেন কাজ শুরু করতে পারেনিথ এমন প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, কমিটিতে সদস্য হিসেবে পুলিশের একজন কর্মকর্তা রাখার কথা বলা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ওই কর্মকর্তার নাম পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া যায়নি। এটি পেলে কাজ শুরু হবে।

জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘অভিযোগ আসতেই পারে। তদন্তের পর দেখা যাবে কতটুকু সত্যতা রয়েছে।’ তিনি জানান, অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ডিআইজির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টি দেখা হবে। আর কমিটি গঠনের বিষয়টি মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি তিনি কথা বলতে রাজি নন বলেও জানান।

উল্লেখ্য, আইজিপির পদমর্যাদা সিনিয়র সচিব। আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের প্রধানের পদমর্যাদা সচিব।

বেশি দামে ক্রয় :জানা গেছে, গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) পুলিশের ব্যবহারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এগুলো কেনা হয়েছে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। কখনও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নামমাত্র দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কখনও দরপত্র ছাড়া এলটিএমের (সীমিত দরপত্র পদ্ধতি) মাধ্যমে সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কাজ দেওয়া হয়েছে ক্রয়ের দায়িত্ব-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সরবরাহকারীকে। তাদের মাধ্যমেই বেশি দামে জিনিসগুলো কেনা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে দ্বিগুণ ও তিন গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে।

গুণগত মানের যুক্তি :পুলিশ সদর দপ্তরের ইকুইপমেন্ট (যন্ত্রপাতি) ও সরবরাহ শাখা সূত্র জানায়, এসব সামগ্রীর গুণগত মান বজায় রাখতে গিয়ে বেশি টাকা খরচ হয়েছে। দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, আগে পুলিশের সরবরাহ করা পোশাক ব্যবহারের দুই-তিন মাসের মধ্যে রঙ জ্বলে যেত। তাই বেশি টাকা দিয়ে মানসম্মত পোশাকের কাপড় কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যসব সামগ্রীর ক্ষেত্রেও তা-ই।

জামা-জুতা প্রতি বছর দেওয়া হয়। গুণগত মানের প্রশ্নে পুলিশের একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, কয়েক বছরে তাদের একই কাপড়েরই জামা-প্যান্ট দেওয়া হচ্ছে। জুতাও গত দুই বছর একই রকম দেওয়া হচ্ছে। দামটা একই রকমেরই হওয়ার কথা। এক বছরে সামান্য দাম বাড়তে পারে, তবে একেবারে দ্বিগুণ হওয়া সঠিক বলে তারা মনে করেন না।

দ্বিগুণ-ত্রিগুণ :সূত্র জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পুলিশের প্যান্ট তৈরির জন্য কমব্যাট টিসি ফ্যাব্রিক (কাপড়) কেনা হয় প্রতি মিটার ২১৪ টাকা দরে। পরের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) একই কাপড় কেনা হয় প্রতিমিটার ৩৯৮ টাকায়। আগে লাইট অলিভ টিসি ফ্যাব্রিক কেনা হতো প্রতি মিটার ১৯১ টাকা দরে। পরের অর্থবছরে কেনা হয়েছে ৩৪২ টাকা দরে। ডিপ গ্রে টিসি ফ্যাব্রিক (বিশেষ পুলিশের জন্য) কেনা হয় ১৮৭ টাকা দরে। পরবর্তী বছর কেনা হয়েছে ৩৪২ টাকা দরে। ডিপ গ্রে টিসি ফ্যাব্রিক কেনা হয় ১৯১ টাকায়। পরের বছরে একই কাপড় কেনা হয় ৩০৯ টাকা ৮৫ পয়সায়। আগে মহানগর পুলিশের জন্য ডার্ক ব্লু টিসি ফ্যাব্রিক কেনা হয় প্রতিমিটার ২০৬ টাকায়। পরের বছরে একই কাপড় কেনা হয় ৩৫৯ টাকায়। আগে ডার্ক ব্লু টিসি ফ্যাব্রিক কাপড় কেনা হয় প্রতি মিটার ১৯৮ টাকা দরে। পরবর্তী অর্থবছরে (২০১৫-১৬) এই কাপড় কেনা হয়েছে ৩৫৯ টাকা দরে। মহানগর ও জেলা পুলিশের জন্য আগের বছরে প্রতি জোড়া বুট কেনা হয় ১ হাজার ৭১ টাকায়। পরের বছরে এই জুতা কেনা হয় ২ হাজার ৩৪০ টাকায়। ক্যানভাস সু আগের বছর প্রতিজোড়া ৪৯৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে, পরের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) একই জুতা কেনা হয় ১ হাজার ৩৩৬ টাকা দরে। মোজা প্রতি জোড়া আগের বছরে কেনা হয় ৩৭ টাকা ৫০ পয়সায়। পরের অর্থবছরে অর্থাৎ গেলো অর্থবছরে তা কেনা হয় ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা দরে। সু-পলিশ আগের অর্থবছরে কেনা হয় ২৪ টাকা ২০ পয়সায়, পরের বছর ৬৯ টাকায়। আগের বছরে বুলেটপ্রুফ ব্যালিস্টিক শিল্ড লেভেল-৩-এ কেনা হয় ৮৮ হাজার ৮০০ টাকায়। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে পরের বছর একই জিনিস কেনা হয় ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকায়। বুলেটপ্রুফ হেলমেট লেভেল-৩-এ আগের বছর কেনা হয় ২৪ হাজার ৮৮২ টাকায়। পরের বছর (২০১৬-১৭) ৩১ হাজার ৮৫০ টাকায়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কেনা হয় গ্যাস মাস্ক ৭ হাজার ২১৯ টাকায়। এক অর্থবছর পর সেটি কেনা হয় তিন গুণের বেশি ২৪ হাজার ৫০০ টাকায়। ভিআইপি হেলমেট (সাদা) ১ হাজার ৬৪৩ টাকায় কেনার এক বছর পরই কেনা হয় ১৯ হাজার ৯০০ টাকায়। মালটিপারপাস বেল্ট ৪ হাজার ৪৪০ টাকায় কেনা হয়, যা আগের বছর ২ হাজার ৭৬৯ টাকায় কেনা হয়েছিল। লাইফ জ্যাকেট, হ্যান্ড গ্গ্নোভস, সেফটি হেড গিয়ার হেলমেট, ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট কেনাকাটায় দ্বিগুণ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই পুলিশের পোশাকসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার নিকটাত্মীয় এসব কাজ কোটেশন ছাড়াই এলটিএমের মাধ্যমে করেছেন।

এমনও হয়েছে, দরপত্রের শর্ত পূরণ করে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও পরে শর্তের বেড়াজালে ওই কাজ শেষ করতে পারেন না। তাদের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। আবার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদবিরে সরবরাহের কাজ পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকেই জিনিস কিনে সরবরাহের জন্য পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করা হয়। অন্যথা হলে ভিন্ন কৌশলে তাদের খেসারত দিতে বাধ্য করা হয়েছে। পিপিআর (সরকারি ক্রয় বিধি) না মেনে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যের অভিজ্ঞতার সনদ চাওয়া হয়। হেলমেট ক্রয়ে একক ছয় কোটি টাকার অভিজ্ঞতার সনদ চাওয়া হয়েছে। অথচ এ ধরনের একক সনদ বাংলাদেশের কোনো সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নেই। এরপরও ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ দিয়ে পছন্দের ব্যক্তির অনুকূলে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (লজিস্টিক) রেজাউল করিম বলেন, প্রতি বছর পুলিশের এসব সামগ্রী ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের মধ্যে যারা ক্রয় আদেশ পান না, তারাই এসব অভিযোগ পুলিশ সদর দপ্তরে করে থাকেন। আগে পুলিশের পোশাক তৈরির জন্য যে মানের কাপড় কেনা হতো, সেগুলো মানসম্মত না হওয়ায় অল্প দিনের মধ্যে রঙ নষ্ট হয়ে যেত। এখন মানসম্মত কাপড় কিনতে টাকা বেশি লাগছে।

তিনি বলেন, এখন পুলিশের আইজি যে মানের কাপড়ের পোশাক পরছেন, একই মানের পোশাক কনস্টেবলদেরও সরবরাহ করা হচ্ছে। আগে অত্যন্ত ভারী মানের জুতা সরবরাহ করা হতো। এখন আমেরিকার সৈনিকরা যে মানের জুতা ব্যবহার করেন, একই মানের জুতা দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে অন্যান্য সামগ্রীর মানও উন্নত করা হয়েছে। যেসব ঠিকাদার অনুন্নত সামগ্রী সরবরাহের জন্য দরপত্র দিয়েছিলেন, তাদের ক্রয় আদেশ দেওয়া হয়নি। নিয়ম অনুসরণ করেই দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
সূত্র : দৈনিক সমকাল।