ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,০৬ জুলাই : কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অসৎ শিক্ষকদের চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নাম সংগ্রহ করা হবে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, যারা সরকারি শিক্ষক এবং যারা এমপিওভুক্ত, তারা ক্লাসে শিক্ষাদান করবেন এটাই নিয়ম। সরকারি অনুমোদন ছাড়া এর বাইরে যদি তারা কিছু (কোচিং) করেন, সেটা আমরা দুর্নীতির মধ্যেই ফেলব। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, কোচিং বাণিজ্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। এই কোচিং বাণিজ্যের কারণেই অনেক অভিভাবক শিক্ষার্থীদের স্কুলে পড়াতে আগ্রহী হন না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সমতা আনতেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করা হয়েছে।
গত ২৭ মার্চ রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘সততা সংঘে’র এক অনুষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, সেদিন খুব কাছে, যেদিন শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের অবৈধ কোচিং সেন্টার বন্ধ হবে। একই সঙ্গে গাইড বইও থাকবে না। শিক্ষকরাই হবেন শিক্ষার্থীদের গাইড। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, আমাদের সন্তানদের আপনাদের কাছে আমানত রেখেছি। আমানতের খেয়ানত করবেন না। তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলুন।
রাজধানীর ১৫টি নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করল দুদক। গত জানুয়ারির প্রথম দিকে শুরু হয় ভর্তি বাণিজ্যবিরোধী অনুসন্ধান। মে মাসে শুরু হয় কোচিং বাণিজ্যবিরোধী অভিযান।
জানা গেছে, দুদক টিমের সদস্যরা এরই মধ্যে গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে কিছু সংখ্যক কোচিং সেন্টারের নাম, সেখানকার শিক্ষক, শিক্ষকদের স্কুল বা কলেজ, আয়-ব্যয়, নামে-বেনামে সম্পদ, সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের নাম ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম সংগ্রহ করেছেন। ওই সব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বলেন, যে কোনো খাতের দুর্নীতি বন্ধে দুদক বদ্ধপরিকর। এর মধ্যে শিক্ষা খাতে দুর্নীতি বন্ধে বিশেষ গুরুত্বসহকারে কাজ করা হচ্ছে। কারণ, এখান থেকেই ভবিষ্যৎ নাগরিকদের চরিত্র গঠন শুরু হয়।
ঢাকা মহানগরের উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু সংখ্যক শিক্ষক যথাযথভাবে পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের তাদের কোচিং সেন্টারে যেতে প্রভাবিত করছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ওই সব তথ্য অনুসন্ধান করা হচ্ছে। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ সাপেক্ষে অবৈধ কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোচিং বাণিজ্যের অন্তর্বর্তীকালীন অনুসন্ধান প্রতিবেদন এরই মধ্যে কমিশনে পেশ করা হয়েছে। কমিশন প্রতিবেদনটি খতিয়ে দেখে এ বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে। ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়-১-এর উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের টিম পুরোদমে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে খ্যাতনামা পাঁচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের শিক্ষকের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
এ ছাড়া মতিঝিল সরকারি বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, অগ্রণী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলি ক্রস বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ উল্লেখযোগ্য আরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা হবে।
দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, এ অনুসন্ধানকালে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে কর্তব্য পালনে অবহেলা ও কোচিং নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করা হবে। ছয় সদস্যের টিম কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছে।
টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- দুদকের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, আবদুল ওয়াদুদ, মনিরুল ইসলাম, ফজলুল বারী ও উপসহকারী পরিচালক আতাউর রহমান।
দুদক সূত্র জানায়, নানাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হবে। তারা শিক্ষার্থীদের পাঠদানে অবহেলা করছেন কি-না, প্রতিদিন স্কুল বা কলেজে হাজির হন কি-না দালিলিক প্রমাণসহ এসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোচিং-সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করা হচ্ছে কি-না, সেটিও গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। কোচিং ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত তাদের সম্পদও খুঁজে বের করা হবে। তার দখলে থাকা সম্পদ বৈধ আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না, তা খতিয়ে দেখা হবে। এর পর নামে-বেনামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে তাদের কাছে নোটিশ পাঠানো হবে। আইন অনুযায়ী নোটিশ পাঠনোর সাত কার্যদিবসের মধ্যে ঢাকাস্থ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সচিব বরাবর সম্পদের হিসাব পেশ করতে হবে। পরে ওই হিসাব যাচাই করে যাদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। যারা যথাসময়ে সম্পদ বিবরণী পেশ করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে দুদকের কাজে অসহযোগিতার অভিযোগে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করা হবে।
জানা গেছে, কোচিং বাণিজ্যের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে এলে কোচিং নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে। মন্ত্রণালয়ের এই নীতিমালা উপেক্ষা করে একশ্রেণির অতিলোভী শিক্ষক অবাধে কোচিং বাণিজ্য চালাচ্ছেন।
নীতিমালায় নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং অথবা প্রাইভেট পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন ছাত্রছাত্রীকে নিজ বাসায় পড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কোচিং সেন্টারের নামে বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দুদকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ওই ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজনকে পড়ালেও তাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। সূত্র: সমকাল।