ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,বরগুনা প্রতিনিধি,১৮ জুন : ‘বাবা কী? বাবা কেমন হয়? বাবারা কি তাঁর ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন? তাহলে আমার বাবা কই? কেন তিনি আমাদের বাড়ি আসেন না। কেন আমার বাবা আমাকে ভালোবাসেন না।
এসবের কিছুই বুঝতাম না একসময়। না বুঝে এমন প্রশ্ন করে মায়ের কষ্টগুলোকে কত যে বাড়িয়ে দিয়েছি তার অন্ত নেই। কিন্তু কেন এমন হলো? মাকে বিয়ে করে, আমাকে জন্ম দিয়ে, কেন আমাদের ফেলে রেখে পালিয়ে গেলেন বাবা?’ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার একজন দরিদ্র রিকশাওয়ালা নূরুল ইসলামের প্রশ্ন এসব।
গ্রীষ্মের খরতাপ কিংবা ভরা বর্ষা কোনো বিরাম নেই তাঁর। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রিকশা চালিয়ে চলছে তাঁর জীবনচাকা। অথচ তাঁর জীবন এমন হওয়ার কথা ছিল না। নূরুল ইসলামের আছেন কোটিপতি বাবা। তাঁর নাম মো. মুজাহার আলী শরীফ। তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ইন্দ্রকূল গ্রামে। বর্তমানে তিনি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বেজগাঁও বিশ্বরোড এলাকায় স্থায়ীভাবে বাস করছেন। সেখানে নিজস্ব বাড়ি রয়েছে তাঁর। সোনালী ব্যাংক শ্রীনগর শাখার একজন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছেন।
সোনালী ব্যাংক শ্রীনগর শাখার ব্যবস্থাপক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, ২০০৫ সালে শ্রীনগর শাখা থেকে মুজাহার অবসরে যান। এরপর বাড়িঘর করে শ্রীনগরে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, মুজাহারের প্রথম স্ত্রী স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁদের দুই মেয়েসন্তান রয়েছে। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর বাবা তাঁদের শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত পাত্রের কাছে বিয়ে দিয়েছেন। অথচ একটিবারের জন্যও তিনি আর খোঁজ নেননি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ও ছেলের।
বাউফল উপজেলার ইন্দ্রকূল গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুজাহারের নামে অনেক জমিজমা রয়েছে। সেসব জমি তাঁর বড় মেয়ের স্বামী মামুন হাওলাদার দেখাশোনা করেন। বাউফলের সূর্যমুনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মুজাহার আমার পরিচিত। একসময় তিনি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় চাকরি করতেন। বর্তমানে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় স্থায়ীভাবে বাস করছেন। দু-তিন বছর পর তিনি একবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তাঁর বড় জামাতা মামুন হাওলাদার গত মেয়াদে সূর্যমুনী ইউপির একজন সদস্য ছিলেন। ’
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, ১৯৭৮ সালের দিকে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) অধীনে একজন স্টোরকিপার হিসেবে চাকরি শুরু করেন মুজাহার। তখন তিনি প্রথম স্ত্রীর তথ্য গোপন করে পাথরঘাটা উপজেলার খাড়াকান্দা গ্রামে দরিদ্র কৃষক আব্দুল গণি হাওলাদারের মেয়ে আনোয়ারা বেগম ওরফে বকফুল বিবির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে আনোয়ারা সন্তানসম্ভাবনা হন। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং পাথরঘাটা উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যস্থতায় বিয়ে হয় দুজনের। বিয়ের কয়েক মাস পর আনোয়ারা একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। সেই ছেলের নাম রাখা হয় নূরুল ইসলাম।
এরপর পাথরঘাটা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে দুই বছর সন্তানসহ আনোয়ারার সঙ্গে একত্রে বাস করেন মুজাহার। দুই বছর পর হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যান তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে স্বামীর দেখা পাননি আনোয়ারা। সেই থেকে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে একাকী জীবন তাঁর। একদিকে সামাজিক বিদ্রূপ; অন্যদিকে অভাবের টানাপড়েন। এবাড়ি-ওবাড়ি ঝিয়ের কাজ করে একমাত্র ছেলেকে বড় করেছেন তিনি। নূরুল ইসলামের বয়স এখন ৩৭ বছর। এই ৩৭ বছরে কখনো বাবার দেখা পাননি। পাননি বাবার আদর-সোহাগ।
অভিমানের সুরে রিকশাচালক নূরুল ইসলাম বলেন, ‘বাবার সম্পত্তি চাই না। এক দিনের জন্য হলেও বাবার সঙ্গে থাকতে চাই। দেখতে চাই বাবার চেহারা। দেখতে চাই বাপ-ছেলের সম্পর্ক কেমন হয়। বাবার সঙ্গে একটু বুক মিলিয়ে একবারের জন্য জানতে চাই, কী অপরাধ ছিল আমার? আমার জীবনটা কেন এমন হলো?’
পাথরঘাটা কৃষি বিভাগে মুজাহারের সঙ্গে চাকরি করতেন স্থানীয় অধিবাসী মো. আব্দুস সোবহান (৬০)। তিনি বলেন, ‘মুজাহার, আনোয়ারা ও তাঁদের ছেলের বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সবার জানা। ’ তিনি জানান, ১৯৭৯ সালের ৪ মে এক হাজার টাকা দেনমোহরে তাঁদের বিয়ে হয়। তখন আনোয়ারা বেগমের বয়স ছিল ২৪ বছর। বিয়ের পর তাঁদের সন্তানের জন্ম।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘একসময় নিরুপায় হয়ে স্বামীর গ্রামের বাড়ি ইন্দ্রকূলে গিয়েছিলাম। শাশুড়িসহ বাড়ির লোকজন আমার সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। বাধ্য হয়ে বছর দশেক আগে পটুয়াখালীর আদালতে মামলা করেছিলাম। সে মামলায় মাসখানেক জেল খেটেছিলেন স্বামী। এরপর অর্থাভাবে আর মামলা চালাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত বিধাতার কাছে বিচার দিয়েছি। ’
সরেজমিনে নূরুল ইসলামের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, বিয়ে করেছেন তিনি। তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মারিয়া সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ে তাঞ্জিলা স্কুলে ভর্তি হয়নি। রিকশা চালিয়ে যে দুই পয়সা রোজগার তা দিয়েই চলছে স্ত্রী-সন্তান, মাসহ পাঁচজনের ভরণ-পোষণ।
পাথরঘাটা সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মুজাহার যা করেছেন, তা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। আনোয়ারার জীবন তো শেষ হয়ে গেছে। এখন ছেলেটা যাতে পৈতৃক পরিচয়সহ তার যাবতীয় অধিকার ফিরে পেতে পারে সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা করা উচিত। ’
পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মরিয়ম চৌধুরী জেবু বলেন, ‘আনোয়ারা ও তাঁর ছেলের বিষয়টি রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দেখা উচিত। ’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অভিযুক্ত মুজাহার আলী শরীফের মুঠোফোনে কল করলে তিনি ‘রং নাম্বার’ বলে সংযোগ কেটে দেন।
বরগুনা-২ (বামনা-পাথরঘাটা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম সরোয়ার হিরু বলেন, ‘মানবিক কারণে বছর দশেক আগে আমি নূরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে মুন্সীগঞ্জে মুজাহারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মুজাহারকে সন্তান মেনে নেওয়ার বিষয়ে অনেক বুঝিয়েছি; কিন্তু তিনি তা শোনেননি।
সৌজন্যে : দৈনিক কালের কন্ঠ।