প্রযুক্তির উত্তরণ না হয় যেন ক্ষতির কারণ

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব মতামত,০৩ জুন : আগেরকার দিনে প্রযুক্তির এত বাহার ছিলনা। যোগাযোগের মাধ্যমও ছিল সীমিত। টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাফ, ফ্যাক্স কিংবা টেলিফোন থাকলেও দূরের যোগাযোগের সহজলভ্য মাধ্যম ছিল চিঠি। প্রেরকের নিকট থেকে সেই চিঠি পেতে ৭-৮ দিন লেগে যেত। আবার কখনো চিঠি গন্তব্যে পৌঁছাতে ১৫ দিনেরও বেশি সময় লাগত। আর বিদেশ থেকে চিঠি আসতে প্রায় মাস পার হয়ে যেত।

আমার গ্রামের বাড়ির পাশে এক বড় ভাই বিদেশে থাকত। তিনি চিঠি পাঠালে দেখতাম মাসাধিক কাল সময় লাগত তা প্রাপকের কাছে পৌছাতে। যখনই কোন পোস্টম্যান তাদের বাড়িতে আসত আমরা ছোটরা সবাই দৌড় দিতাম তাদের বাড়ির দিকে। আর বলতাম, বাবুল ভাইয়ের চিঠি এসেছে।

কিন্তু, প্রযুক্তির কল্যাণে আজ সারা বিশ্ব যেন একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও কেউ মনে করে না আজ সে দূরে অবস্থান করছে। আমাদের দেশের উন্নয়নের বড় ভাগীদার প্রবাসী ভাইয়েরা প্রায় প্রতিদিনই আজ বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে বা প্রিয়জনদের সঙ্গে ইমো, ভাইবার বা ফেইসবুকে ভিডিও কল, ভিডিও কনফারেন্স বা চ্যাটিং করে থাকে। আজকাল গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে,শহরে-বিপনীতে,অফিস-আদালতে অর্থাৎ যেখানে যান না কেন ছোট-বড় সবারই হাতে মোবাইল, প্যাড, ল্যাপটপ বা অন্যকোন ডিভাইস তো পাবেন। মোবাইল যেন আজ আমাদের মৌলিক চাহিদার একটি বস্তু হয়ে গেছে। রিক্সাতে উঠবেন তো দেখবেন রিক্সাওয়ালার পকেটে মোবাইলে গান বাজছে বা রিংটোন বাজছে।

অনেক সময় দেখবেন রিক্সাওয়ালা চলন্ত অবস্থায় বাড়ির খোঁজ নিচ্ছেন। গিন্নীকে বলছেন নিজের ভালো-মন্দের কথা। খোঁজ নিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার। অনেক রিক্সওয়ালাকে দেখবেন কার সঙ্গে যেন খোশ গল্প করছে। আমি একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাসায় আসার জন্য একটি রিক্সায় উঠলাম। পথিমধ্যে রিক্সাওয়ালার ফোন এলো। বুঝলাম বাড়ি থেকে তার স্ত্রী ফোন করেছে। তিনি বলছেন- কেমন আছ? বাবু আর ময়নার লেখাপড়ার কি খবর? ঠিকমত স্কুলে যায় তো?. . .  না এখন যাবেনা। তিনি বললেন, আমি সামনের মাসে আসলে একসাথে যাব (মনে হলো গিন্নী ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাবেন তাই তার সাথে শেয়ার করছেন)।

ইতোমধ্যে রিক্সাটি আরেকটি রিক্সার সঙ্গে লেগে গেছে। তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে লোকটিকে আমি পিছন থেকে বারবার বলছিলাম, মামা, রিক্সাটা রাস্তার এক পাশে থামাও, তারপর কথা বল। তার তো ডন্ট কেয়ার ভাব। হয়ত মারাত্মক কোনো এক্সিডেন্টও হতে পারত। আজকাল চলন্ত অবস্থায় বিশেষ করে মোটর সাইকেল বা গাড়ি চালানোর সময় অনেককে মোবাইলে কথা বলতে দেখা যায়। এটা একেবারেই অসচেতনতার পরিচয়। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে যেকোনো মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এমন অনেক দুর্ঘটনাও ইদানিং অহরহ ঘটছে।

আমি ২০১৬ সালে ভোলায় “কোস্ট ট্রাস্ট” নামে একটি এনজিও পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল মনপুড়ায় যাব। কিন্তু, সেদিন মেঘনা খুবই উত্তাল ছিল। তারপরও দেখছি  কয়েকটি স্পিড বোট এ খারাপ আবহাওয়াতেও মনপুড়ার দিকে যাচ্ছে। উতাল-পাতাল ঢেউয়ের মাঝে বোটটি দোল খাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে কোন একদিকে পড়ে যাবে। আমার ভয় লাগছিল। কিন্তু, আরোহীরা অত্যন্ত দুঃসাহসী কিংবা একান্ত দরকার থাকায় তারা যাত্রা করেছে।

উক্ত প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারী আমাকে বলছিলেন, স্যার, আজ যাওয়া যাবেনা। তাই আর যাওয়া হলোনা। তিনি আরো বললেন, মনপুড়ার অনেক পরিবারকে দেখা যায় ঢাকা থেকে বাজার করে খায়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে? তিনি বললেন, প্রায় প্রতিটি পরিবারের একজন না একজন ঢাকায় থাকেন। মা বা গিন্নী মোবাইলে বলে দেন তার আগামীকাল কি কি লাগবে… সেই অনুযায়ী তারা ঢাকা থেকে বাজার করে লঞ্চে দিয়ে দেয় আর পরিবারের সদস্যরা তা সকাল বেলা ঘাট থেকে নিয়ে আসে। আজ প্রযুক্তি মনপুড়ার মত প্রত্যন্ত অঞ্চলকেও ঢাকার সাথে যুক্ত করেছে খুব সহজে।

আপনি বাসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ডাক্তারের চেম্বারে যেতে পারছেন না আপনি গ্রামীণের সেবা ডট কমে গিয়ে বুকিং দেন। আপনার একটি বই দরকার আপনি চাইলে আমাজন ডট কমে অর্ডার দিতে পারেন কিংবা রকমারী ডট কমে অর্ডার দিতে পারেন। তারা আপনার বাসায় আপনার কাঙিক্ষত বস্তু পৌছে দিবে।

এবার আমি আমার কলিগসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় সনির সো রুমে গেলাম এলইডি টিভি  কিনতে। দামপত্র ও কেনাকাটা সবই হলো। এবার টিভি নিয়ে আসার পালা। আমি আমার কলিগকে বললাম, এত ভিড়ের মাঝে কিভাবে এটা বাসায় নিয়ে যাবেন? তিনিও  তাই বললেন। কিন্তু, ম্যানেজার আমাদের অবস্থা লক্ষ করে বললেন, স্যার, আপনাদের কোন সমস্যা নাই। আপনাদের বাসার কোথায়? আমার কলিগ বললেন, কল্যাণপুরে। ম্যানেজার বললেন, আপনি চাইলে আপনার আশেপাশের যেকোনো সনির শো রুম থেকে আপনার ক্রয়ের রসিদ দেখায়ে তা নিতে পারেন।

আমার কলিগ জানালেন, আমি এটা ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া পাঠাব। ম্যানেজার বললেন, আচ্ছা, কোনো সমস্যা নেই। আমরা আপনার সব ডকুমেন্ট ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আমাদের শো রুমে পাঠায়ে দিচ্ছি। আপনি আপনার বাসার ঠিকানা বলেন এবং যিনি এটা গ্রহণ করবেন তার মোবাইল নাম্বার দেন। আমাদের লোক আপনার বাসায় গিয়ে আপনার টিভি দিয়ে আসবে।

আজকাল রাস্তা-ঘাটে বের হলে দেখবেন, মানুষ চলন্ত অবস্থায় কথা বলছে, কেউবা চ্যাটিং করছে, কেউবা ভিডিও দেখছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষত, উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েদের বাইরে বের হলে সঙ্গে একটা এনড্রয়েড ফোন অবশ্যই থাকা চাই। চাই একটা চশমা। কিংবা সঙ্গে থাকবে একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা। আর বাবা ধনী ব্যক্তি হলে একটা বাইক সঙ্গে থাকা চাই। তারা প্রায় অধিকাংশ সময় পড়ালেখাতে ব্যয় না করে চ্যাটিং, ভিডিও দেখা, ফেইসবুকে, কেউবা ফেইসবুকে লাইভ থাকা, গেম খেলা, ইমো, ভাইবার ইত্যাদিতে ব্যয় করছে। বিশেষ করে দেখা যায় কয়েকজন একসাথে বসে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছেনা। তবে সবাই মোবাইল নাড়াচাড়া করছে। এত কাছে তবু যেন দূরে। এমন তাদের অবস্থা।

সর্বোপরি বলতে হয়, আমাদের সামাজিক সম্পর্কটা দিনদিন ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক বন্ধন ঢিলা হয়ে যাচ্ছে। বড় পরিবার ক্ষুদ্র পরিবারে পরিণত হচ্ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমানে যৌথ পরিবারের বদলে একান্নবর্তী বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার যাদের সন্তান বিদেশে থাকে তাদের বিষয়টা একটু ভিন্ন। বাবা-মা কিংবা মা একাই দেশের বাড়িতে থাকেন। সপ্তাহে, মাসে কিংবা বছরে দু’একবার হায় হ্যালো করে মা-বাবার খোঁজ নেন। এইতো এর মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এছাড়াওঅনেক সময় মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমের মত কারাগারে থাকতে বাধ্য হতে হয়। যার নজীর আমাদের সমাজে আজ অহরহ। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত ছেলেমেয়ে থাকার পরও এমন কারাগারে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে। মানুষ দিনদিন খুব বেশি পরিমাণে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে।

প্রযুক্তি আমাদের সভ্যতাকে কয়েকশ’ বছর এগিয়ে দিলেও আমরা যথাযথভাবে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ, আমরা এর সঠিক ব্যবহার করছিনা। প্রযুক্তি আমাদের জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ হবে যদি আমরা এর যথার্থ ব্যবহার করতে পারি।

বাংলাদেশ ২০১৪ সালে “ডিমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ড” এ প্রবেশ করেছে। আশা করা হচ্ছে ২০২১ সালে পরিপূর্ণভাবে মাধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে। কিন্তু, যারা আজ আমাদের রত্ন তারা তাদের অধিকাংশ সময় আমাদের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যয় করছে নাকি অন্য কোথাও তা বিলিয়ে দিচ্ছে সেটা নিয়ে আমাদের সকলকে ভাবতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো “ডিমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ড” প্রবেশ করলেও তারা তাদের কর্মক্ষম লোকদের যথার্থ ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আজ তারা পুরোপুরি তেলের উপর বা পর্যটনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অপরদিকে, জাপান, দ. কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, তাইওয়ান, বর্তমানে ভারত ও চীন তাদের কর্মক্ষম যুব সমাজের যথার্থ ব্যবহার করে উন্নয়নের স্বর্ণশিখরে আরোহন করছে।

আমরা যতই উন্নয়নের মডেল প্রস্তুত করি না কেন আমাদের কর্মক্ষম লোকদের যথাথভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলে একসময় তার খেসারত দিতে হবে এ সমাজ ও জাতিকে।
মোঃ আব্দুর রশিদ
সহকারী ব্যবস্থাপক (কাযক্রম বিভাগ)
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), আগারগাঁও, ঢাকা।