এত অস্ত্র কার

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,রুপগঞ্জ প্রতিনিধি,০৩ জুন : এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে একটি খাল। পাশেই তিনশ’ ফুট পাকা রাস্তা। সেখানে যান চলাচল থাকলেও নিরিবিলি এলাকাটিতে জনবসতি প্রায় নেই বললেই চলে। এমন শান্ত-নির্জন এলাকায় গতকাল শুক্রবার সকালে হঠাৎ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আনাগোনা। স্থানীয় উৎসুক লোকজনও খবর পেয়ে ভিড় জমালেন। এর পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল এলাকার সেই খাল থেকে উদ্ধার হলো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ। এর মধ্যে দুটি রকেট লঞ্চার ও ৬২টি এসএমজিও রয়েছে। এত অস্ত্র দেখে স্থানীয়রা তো বটেই, খোদ উদ্ধারকারীরাও তাজ্জব বনে গেলেন। কিন্তু কোথা থেকে এলো এসব অস্ত্র? আর এত অস্ত্র মজুদের উদ্দেশ্যই বা কী? পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে একটি চক্র এসব অস্ত্র মজুদ করেছিল। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সফলতা, উন্নয়ন ও জননিরাপত্তা নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এটাও ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে।

এর আগে গত বছরের জুনে উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে তিন দফায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। কে বা কারা, কেন সেসব অস্ত্র মজুদ করেছিল সে রহস্য এখনও জানা যায়নি। ওই ঘটনার এক বছরের মাথায় পূর্বাচলের খাল থেকে উদ্ধার হলো বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এ ঘটনা তদন্তে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা

দিতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

রূপগঞ্জের খাল থেকে উদ্ধার অস্ত্রের মধ্যে ৬২টি চায়নিজ এসএমজি ও দুটি রকেট লঞ্চার ছাড়াও রয়েছে ৪৯টি রকেট লঞ্চার প্রজেক্টর, পাঁচটি ৭.৬২ পিস্তল, ৪৯টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৪৯টি ডেটনেটর, এসএমজির ম্যাগাজিন ৬০টি, দুটি ওয়াকিটকি, একটি দুরবিন, ১৩টি অ্যান্টেনা, বিপুল পরিমাণ টাইমফিউজ, ইগনাইটার ও এক হাজার ৫২৭টি গুলি। ব্যাগে ভরে পলিথিনে মুড়িয়ে এগুলো পানিতে রাখা হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা যায়, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাস্থল ঢাকা জেলার সীমান্তবর্তী রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহরের পাঁচ নম্বর সেক্টরের ভূঁইয়াবাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন গুতিয়াবো এলাকা। এর থেকে অল্প দূরেই কাঞ্চন ব্রিজ। রাস্তার ধারে ভিড় জমিয়েছেন প্রচুর মানুষ। সামান্য দূরে খাল ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থান। কয়েক ঘণ্টা আগেই খাল থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র-গুলি মাটিতে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। কাছাকাছি কাউকে যেতে দিচ্ছে না পুলিশ।

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের বাগলা এলাকার মোসলেম উদ্দিনের ছেলে শরিফের বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে বলে গোপন সূত্রে খবর পায় পুলিশ। এর পর গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রূপগঞ্জ থানা পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়ে একটি এলএমজি উদ্ধার করে। তবে অভিযানের সময় অস্ত্রের মালিক শরিফুল ইসলাম ওরফে শরিফ মিয়া পালিয়ে যায়। পরদিন দুপুরে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মাহমুদুল ইসলাম ও রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পূর্বাচলের গুতিয়াবো আগারপাড়া এলাকার বালুরমাঠ থেকে মাটি খুঁড়ে দুটি এসএমজি উদ্ধার করে। এর সূত্র ধরে আরও অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ভূঁইয়াবাড়ি ব্রিজসংলগ্ন খালে বিপুল অস্ত্র-গোলাবারুদ থাকার তথ্য পাওয়া যায়। পরে গতকাল সকালে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদের সাহায্যে জলাশয় থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, দড়ি দিয়ে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বাঁধা ছিল অস্ত্রের ব্যাগগুলো।

ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন সমকালকে বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সকাল সাড়ে ৬টায় তাদের বিষয়টি জানানো হয়। এর পর সোয়া ৭টা থেকে ডুবুরি দল তল্লাশি শুরু করে। খালের পাড় থেকে আনুমানিক দেড়শ’ ফুট এলাকার মধ্যেই অস্ত্রের ব্যাগগুলো পাওয়া যায়। ট্রাভেল ব্যাগগুলোর ভেতরে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় ছিল অস্ত্র-গোলাবারুদ।

তল্লাশিতে অংশ নেওয়া ডুবুরি শাহজাহান মিয়া জানান, পুলিশ গ্রেফতার দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। তারাই অস্ত্র থাকার সম্ভাব্য জায়গাটি দেখিয়ে দেয়। এর পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম দফায় বেলা ১১টা পর্যন্ত অভিযানে ২২টি ব্যাগ পাওয়া গেলেও এর পাঁচটি ছিল খালি।

এর আগে রাজধানীর তুরাগের দিয়াবাড়ি খাল থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে অংশ নেওয়া ডুবুরি আবু ইউসুফ সমকালকে বলেন, দিয়াবাড়িতে উদ্ধার হওয়া ম্যাগাজিনের গুলি এখানকার অস্ত্রগুলোয় ব্যবহার উপযোগী। তবে দিয়াবাড়িতে অস্ত্র-গুলি ছিল নতুন অবস্থায়। আর রূপগঞ্জের অস্ত্র-গুলিতে কিছুটা মরিচা পড়েছে। এটা ব্যাগের ভেতর পানি ঢুকে যাওয়ার কারণে হতে পারে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গুতিয়াবো এলাকাটি একসময় জনবহুল ছিল। পরে পূর্বাচল উপশহর গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজউক পুরো এলাকা অধিগ্রহণ করে। বর্তমানে ফাঁকা এ এলাকায় মাঝে মধ্যেই লাশ পাওয়া যায়। পূর্বাচল উপশহরের পুরনো বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম জানান, এ এলাকায় লোকজন না থাকলেও প্রায়ই গাড়িতে করে অচেনা লোকজন আসে। নানা অপরাধও সংঘটিত হয়। গতকালের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাস্থলের অদূরে দু-একটি বাড়ি থাকলেও দুপুরে সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে তিনজনকে আটকের কথা শোনা গেলেও পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গোপনীয়) মনিরুজ্জামান বলেন, একজন মাদক ব্যবসায়ীকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্যে অভিযান চালানো হয়। অন্য কাউকে আটক করা হয়নি। অভিযানে সহায়তার জন্য হয়তো কাউকে সঙ্গে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মঈনুল হক বলেন, জলাশয়ে আরও অস্ত্র থাকতে পারে। প্রয়োজনে পানি সেচে তা উদ্ধার করা হবে।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মাহমুদুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি গোলাম দস্তগীর গাজী, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফোরকান শিকদার, সহকারী পুলিশ সুপার (গ সার্কেল) আবদুল্লাহ আল মাসুদ, র‌্যাব-১-এর কোম্পানি কমান্ডার আবু হানিফ, র‌্যাব-১১-এর এসপি বাবুল আক্তার, নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের ডিএডি মামুনুর রশিদ প্রমুখ।

ঘটনাস্থলে আইজিপি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো অপরাধী চক্র তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য অস্ত্রগুলো ব্যবহার করত। নারায়ণগঞ্জ জেলা ডিবির তৎপরতায় এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু এক ব্যক্তির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অস্ত্রগুলোর সন্ধান মিলেছে, তাই আশা করা হচ্ছে এর পেছনের সূত্র পাওয়া যাবে। সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। অস্ত্রগুলো আড়াই বা তিন মাস আগে সেখানে রাখা হয় বলেও ধারণা আইজিপির।

পূর্বাচলের ওই খালে আরও অস্ত্র-গোলাবারুদ আছে কি-না নিশ্চিত হতে সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যায় জাল ফেলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। তবে তখন হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আজ শনিবার সকাল পর্যন্ত স্থগিত করা হয় অভিযান। এর আগে বিকেলে গ্রেনেডগুলোর বিস্ফোরণ ঘটায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল। শরিফকে ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সৌজন্যে : দৈনিক সমকাল