ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ বিডি ডট কম,নিজস্ব প্রতিনিধি,২৪ এপ্রিল : প্রতারণার সব কৌশলই রপ্ত করেছিলেন নাসির উদ্দিন। শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়ায় প্রথমে তাকে এলাকার মানুষ চিনতো কোটিপতি নাসির হিসেবে। প্রায় এক বছর আগে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পর পরিচিত হয়ে উঠেন ‘হেলিকপ্টার নাসির’ নামে।
সম্প্রতি রাজধানীর শাহ আলী থানার একটি প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। এরপরই তার কোটিপতি হওয়ার চাঞ্চল্যকর সব অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। এবার তার পরিচিতি হয় ‘ভিআইপি প্রতারক’ হিসেবে।
নাসির বর্তমানে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন। ওই থানার একটি মামলায় চারদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বাঁশখালী থানা পুলিশ। শুক্রবার ছিলো জিজ্ঞাসাবাদের তৃতীয় দিন।
গত ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দুই দফায় চারদিনের রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করলে, আদালত নাসিরকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। পরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা পুলিশ অন্য একটি মামলায় তাদের হেফাজতে নিয়ে যান।
এদিকে নাসিরের হাতে প্রতারিত অনেকেই বৃহস্পতিবার (৬ মার্চ) পর্যন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা কার্যালয়ে ভিড় করেন। এদের মধ্যে ঢাকা চলচ্চিত্রের একজন চিত্র নায়কও আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই চিত্রনায়ক বলেন, ‘নাসির ১০টি সিনেমা তৈরির প্রলোভন দেখিয়ে এফডিসির নায়ক-নায়িকাদের ঘনিষ্ঠ হন। এজন্য প্রতিদিনই নতুন নতুন বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে এফডিসিতে আসতেন। সিনেমার শুটিংয়ের সেট তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর তিনি টাকা না দিয়েই পালিয়ে যান।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. কুতুবুর রহমান মিঞা বলেন, ‘বিভিন্ন ফাঁদ পেতে মানুষের টাকা মেরে দেওয়াই মূলত নাসিরের পেশা। কখনও নিজেকে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের একমাত্র পাথর সরবরাহকারী, আবার কখনও চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দেন। এই পরিচয়েই ধনাঢ্য লোকজনের সঙ্গে ওঠা-বসা করেন নাসির। পদ্মাসেতু ও পাওয়ার প্ল্যান্টের মতো বড় বড় ঠিকাদারী কাজে টাকা বিনিয়োগের কথা বলে মোটা অঙ্কের লভ্যাংশ দেওয়ার প্রলোভন দিতো তাদের। লাখ টাকার লেনদেনে স্বচ্ছতা রেখে প্রথমেই তিনি আস্থা অর্জন করতেন। ধীরে ধীরে সেই অঙ্ক কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেই নাসির লাপাত্তা হয়ে যেতেন।’
এভাবে গত এক যুগে প্রতারক নাসির অনেকের কাছ থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে তারা তথ্য পেয়েছেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা কুতুবুর রহমান। এখনও পর্যন্ত নাসিরের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগে সাতটি মামলা হয়েছে। আরও ডজনখানেক প্রতারিত ব্যবসায়ী মামলা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
এদের একজনের নাম মো. মাসুদ রানা। ‘মা এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের পাথর সাপ্লাই ও বাঁশখালীতে সরকারি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ঠিকাদারী কাজের পার্টনারশিপ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রথম দফায় ২০ লাখ টাকা নেন নাসির। কিছুদিন পরই মোটা অঙ্কের লভ্যাংশসহ ওই টাকা ফেরত পান মাসুদ রানা। এতে তার মনে বিশ্বাস জন্মে, লাভের আশাও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে রানা আরও ৪০ লাখ টাকা নাসিরকে দেন। অল্প সময়ের মধ্যে সেই টাকাও সুদে-মূলে ফেরত পেয়ে রানা আত্মহারা হয়ে যান। স্বপ্ন বুনতে থাকেন আরও লাভের। এবার পরিচিতজনদের কাছ থেকে লোন নিয়ে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা তুলে দেন নাসিরের হাতে। ‘বেশি টাকায় বেশি লাভ’ এমন উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন মাসুদ রানা। সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে যায়, কিন্তু খোঁজ নেই নাসিরের। তার কাছ থেকে আর টাকাও আসে না। রীতিমত টেনশন বাড়তে থাকে। মাসুদ রানা এবার ফোন করেন নাসিরের মোবাইল ফোনে। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। ততক্ষণে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
পরে গত ৮ মার্চ মাসুদ রানা শাহ আলী থানায় প্রতারণার মামলা করেন। ৯ মার্চ রাজধানীর ছনটেক এলাকা থেকে নাসিরকে গ্রেফতার করেন শাহ আলী থানার ইন্সপেক্টর দুলাল হোসেন। পরে মামলাটির তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
গোয়েন্দারা জানান, ঢাকায় গ্রেফতারের খবর পেয়ে তার ব্যবসায়িক অংশীদার হাটহাজারী থানার বাসিন্দা ওসমান গনি বাদী হয়ে গত ৮ মার্চ ৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বাঁশখালী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
আর এক কোটি ৩০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাবনা জেলার আমিনপুর থানার আহমদপুর এলাকার মৃত আব্দুল আজিজের পুত্র মাসুদ রানা বাদী হয়ে একইদিনে রাজধানীর শাহ আলী থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন। সাড়ে তিন কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগে ১০ মার্চ রাজধানীর কাফরুল থানায় দু’টি মামলা করেন পাবনার আমিনপুর থানার হরিদেবপুর এলাকার নুরুজ্জামান মিয়ার পুত্র মেসার্স জামাল স্টিল হাউসের মালিক মনিরুজ্জান মনি।
এছাড়া নোয়াখালীর শহীদুল্লাহর কাছ থেকে নাসির হাতিয়ে নেন ১০ কোটি টাকা। মধুমতি ব্যাংকের পরিচালক আব্দুর রহিম বাবলুর কাছ থেকে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকার রিয়াদ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০ কোটি টাকা, পাবনা জেলার আমিনপুর থানার আহমদপুর এলাকার খন্দকার শফিউর রহমানের পুত্র ঠিকাদার আরিফ খন্দকারের ২৯ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিনের ৫ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অনিকের ৩০ কোটি টাকা, মাওনা (গাজীপুর) থানার মোহাম্মদ জুয়েলের ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাত করেন নাসির।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন