অস্বাভাবিক মৃত্যু যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না। আমরা স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিবাহিত করলেও মনে হয় সত্যিকার অর্থে আজও আমরা স্বাধীনতার সাধ পাচ্ছি না। অনাকাঙ্খিত মৃত্যু যেন আমাদের মাকড়শার জালের মতো প্রতিটি জীবনকে আকড়ে ধরে আছে। কথায় কথায় মারামারি কাটাকাটি যেন আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুরির দায়ে প্রকাশ্যে শিশু, যুবক ও মহিলাকে পিটিয়ে হত্যা, যৌতুকের দাবীতে গৃহবধুকে পিটিয়ে, গরম পানি ঢেলে অথবা এসিড নিক্ষেপ করে হত্যা, পরকীয়ার অভিযোগে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে পিটিয়ে হত্যা অথবা মাথা ন্যাড়া করে জুতার মালা গলায় পড়িয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরানোর কারণে আত্মহত্যা করা, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা পড়–য়া ছাত্রীদের ধর্ষণ বা গণধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা, পারিবারিক কোলহলকে কেন্দ্র করে স্ত্রী হাতে স্বামী অথবা স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, বাবার হাতে ছেলে অথবা ছেলের হাতে বাবা, বোনের হাতে ভাই অথবা ভাইয়ের হাতে বোন, পরকিয়ার আসক্ত হয়ে মার হাতে ছেলে-মেয়ে অথবা বাবার হাতে ছেলে-মেয়ে খুন, পূর্বশক্রতার জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজনকে পিটিয়ে, কুপিয়ে অথবা গুম করে হত্যা, বিনোদনকে কেন্দ্র করে একে অপরকে হত্যা, লাশ টুকুরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে রাখা, পাহাড়ে ধসে, নৌকা বা লঞ্চ ডুবে মানুষ মারা যাওয়াসহ নদী-নালা, খাল-বিল, ডোবা-জঙ্গলে অহরহর পাওয়া যাচেছ গলিত-অর্ধগলিত মৃত দেহের সন্ধান। এত সব মৃত্যুর মধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা।
গত ২৫ জুলাই বিভিন্ন পত্রিকার আলোকে দেখা যায়, মহাসড়কে মূল্যহীন প্রাণ; ঈদের ১০ দিনে নিহত ২৪২ জন (প্রথম আলো), সড়কে এক দিনে ঝরল আরো ২৪ প্রাণ; ১০ জেলায় এসব দুর্ঘটনায় আহত ৪২ জন (কালেরকন্ঠ), মহাসড়কে ৭ দিনে প্রাণ গেল ১১৮ জনের (মানবজমিন), অসহায় আত্মসমর্পণ; সড়ক দুর্ঘটনা ছয় জেলায় নিহত ১৪ (আলোকিত বাংলাদেশ), ১৪৪ বিপজ্জনক বাঁকে পাঁচ বছরে ১১৫০ দুর্ঘটনা; মহাসড়কে মৃত্যুফাঁদ (বাংলাদেশ প্রতিদিন), ছুটির দিনে দুর্ঘটনায় নিহত ২৪ (মানবকন্ঠ), ঈদযাত্রায় নিহত ২৪৫; মহাসড়কে মহাবিপদ (ইনকিলাব), আট জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৭ (যায়যায়দিন), সড়কে প্রাণ গেল পুলিশ সদস্যসহ ২১ জনের (যুগান্তর), সড়কে ঝরে গেল আরও ১৭ প্রাণ (সমকাল), পথে পথে মৃত্যু; আরও ১৬ প্রাণ গেল (জনকন্ঠ), সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত; আহত ৬০ (নয়া দিগন্ত), মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলো আরও ১৬ প্রাণ (ভোরের কাগজ), সড়কে আরো ঝরল ২৩ প্রাণ (ইত্তেফাক), সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ; ঝরল আরও ১৬ প্রাণ (সকালের খবর), সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না; রাজধানী ও আট জেলায় নিহত আরও ২১ (ভোরের পাতা), থামছেই না মৃত্যুর মিছিল; নয় জেলায় সড়কে ঝরল আরো ১৮ প্রাণ (আজকের পত্রিকা), গতকাল নিহত ২০; সড়কে কান্না থামছে না (দৈনিক জনতা)।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিসংখ্যা অনুসারে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন সারা দেশে গড়ে ৭ জন মারা যায়। ঈদের সময় এ সংখ্যা বেড়ে ৩ থেকে ৪ গুণ হয়। বছরে গড়ে ১২ হাজার লোক নিহত ও ৩৫ হাজার লোক আহত হন। দেশের ২১ হাজার কিলোমিটার মহাসড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ ২০৯টি জায়গা চিহ্নিত করেছে বুয়েটের এ দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র যার মধ্যে ১৪৪টি জায়গা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সংস্থাটির মতে, কুমিল্লা জোনে ৮টি, সিলেট জোনে ১৪টি, চট্টগ্রাম জোনে ৩২টি, খুলনা জোনে ১১টি, বরিশাল জোনে ১২টি, ঢাকা জোনে ১৯টি, উত্তরবঙ্গের রংপুর জোনে ২২টি ও রাজশাহী জোনে ২৬টি বিপজ্জনক ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোর মধ্যে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের জরিপে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন বছরে প্রায় ১২ হাজার; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এটা প্রায় ১৮ হাজার। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির ১ থেকে ২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা! এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ১২টি দেশের মধ্যে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে বাংলাদেশে নিহতের হার সর্বোচ্চ এবং এ সংখ্যা ১৬৯ জন।
এতোসবের পরেও আমাদের একমাত্র চলাচলের মাধ্যম হলো সড়ক পথ। কিন্তু এ সড়ক পথেই প্রতিদিন চলে অসংখ্য দুর্ঘটনা। যার ফলে নিঃশেষ হয়ে যায় অসহায় কিছু প্রাণ। কারো কারো পরিবারে নেমে আসে অভাবের কালো ছায়া। কিন্তু কেন হয় সড়ক পথে দুর্ঘটনা? কী তার প্রতিকার? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য এখানে কিছু প্রতিকার তুলে ধরা হলো। আশা করবো সরকার এ ব্যাপারে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিবে।
১. মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সবিহীন ও লক্কর-ঝক্কর গাড়ি সড়ক পথে চলতে দেয়া যাবে না।
২. একজন চালককে মোটামুটি শিক্ষিত, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ও লাইসেন্স গ্রহণ করার পর গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
৩. বাংলাদেশের অকেজো, ভাঙা, আঁকাবাঁকা ও সরু রাস্তাগুলো মেরামত করা যেতে পারে। যে রাস্তাগুলো দূরত্ব বেশি সে রাস্তায় অনেক গাড়ি চলাচল করে সে রাস্তাগুলো ওয়ান বাই ওয়ান করা যেতে পারে।
৪. গাড়ি চালানোর সময় বেপরোয়া ওভার টেকিং নিষিদ্ধ করা যেতে পারে এবং ওভার টেকিং এর মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো চালকে অভিহিত করা যেতে পারে।
৫. গাড়ি চালানোর সময় ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট জায়গা এবং ওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
৬. কিছু কিছু নির্দিষ্ট রাস্তায় শুধু বড়ো গাড়ি বা কিছু কিছু নির্দিষ্ট রাস্তায় ছোট গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গাড়ি চালু করার পূর্বে গাড়ির ক্রটিসমূহ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে একটি আইন করা যেতে পারে। গাড়ির অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে পারবে না।
৭. একজন চালক সর্বোচ্চ ৫ দিন একটানা গাড়ি চালানোর পর ২ দিন বিশ্রাম নেয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে, দেখা যায় অনেকদিন যাবৎ একটানা গাড়ি চালাতে চালাতে শরীর ক্লান্তি, অবসাদ এসে যায় ফলে অনেক চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে। আর তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। কিছু কিছু চালক গাড়ি চালানোর আগে মাদক সেবন করে থাকে। চালক যাতে গাড়ি চালানোর সময় মাদকসক্ত না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
৮. দুর্ঘটনা ঘটার পর কি কারণে দুর্ঘটনা ঘটলো যাবতীয় তথ্যগুলো সংরক্ষণ করার জন্য একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সবগুলো চালকদের বেশকয়েকটি ভাগে ভাগ করে ৩ মাস বা ৬ মাস অন্তর অন্তর সেমিনার-সিম্পুজিয়াম করা যেতে পারে। সেখানে দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং মনিটরিং কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী জেলাভিত্তিক শ্রেষ্ঠ চালককে জাতীয়ভাবে পুরস্কার প্রদান করা যেতে পারে।
৯. সাধারণ জনগণকে নিয়ে দুর্ঘটনার কারণ, দুর্ঘটনার প্রতিকার, সড়কপথে চলাচলের আইন কানুন, রাস্তাঘাটে চলাচলের বিভিন্ন দিকগুলো নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করে জ্ঞাত ও সচেতন করা যেতে পারে।
১০. উপরোক্ত প্রতিকারগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারি বেসরকারি একটি সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে। যাদের কাজ হবে আইনগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না বা না হলে এর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা।
একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কথা ওঠেছে, দেশে সুশাসন নেই বলেই নিষ্ঠুরতা বাড়ছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে সুশাসন থাকবে না, মানুষ যত্রতত্র হত্যার শিকার হবে, নদী-নালা-ডোবায়, পথে প্রান্তরে, রাজপথে মারা যাবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তারপরও আমাদের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আহতদের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশকে পরিবর্তন করে এ বছরই আইনে পরিণত করার ঘোষণা দেন। আশা করি মন্ত্রীর উক্ত ঘোষণা বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিক হবে এটা আমাদের প্রত্যাশা।
==========================
লেখক :- নাজমুল করিম ফারুক
সাধারণ সম্পাদক, তিতাস প্রেসক্লাব
কড়িকান্দি বাজার, তিতাস, কুমিল্লা।
মোবাইল : ০১৮১৮-০০৪২৭২
ই-মেইল : nazmulkf09@gmail.com