দাউদকান্দির সুন্দরী রুমির বাল্যবিয়ে॥ মৃত্যুই হলো শেষ পরিণতি–মো. আলী আশরাফ খান,দাউদকান্দি

SHARE

ঘটনাটি সম্ভবত ২৮ আগস্ট ’১৫ সালের। জরুরি একটি কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম সেদিন। কাজ শেষে দাউদকান্দির গৌরীপুরে ফেরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম যাত্রাবাড়িতে। হঠাৎ একটি মাধ্যম হতে খবর পেলাম, দাউদকান্দির হুগুলিয়ায় ১৩ বছরের এক নাবালিকার বিয়ে হচ্ছে। খবরটিকে আমি গুরুত্ব দিয়েই জরুরিভিত্তিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন বাস-ই পাচ্ছিলাম না ওইসময়। বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষার পর একটি সাংবাদিকের গাড়ি আমাকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দির বারপাড়ার সন্নিকটে পশ্চিম হুগুলিয়া গ্রামে পৌঁছে দেয়।

সংবাদের যথাযথ সত্যতা পেয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে অবগত করলে প্রশাসন এগিয়ে আসেন বাল্যবিয়েটি বন্ধ করার জন্য। দাউদকান্দি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শামীমা সুলতানা পুলিশের সহযোগিতায় ওইদিন বাল্যবিয়েটি বন্ধ করতে সক্ষম হন। উপজেলার গৌরীপুর ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আয়েশা আক্তার,  মুক্তি মেডিকেল সেন্টারের স্বত্বাধিকারী ডাঃ মোজাম্মেল হক, সমাজসেবী সাইফুল ইসলাম স্বপন, আব্দুল মতিন, সাংবাদিক জসিম উদ্দিন জয় এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সেইদিন নাবালিকা কনে ও ছেলের অভিভাবকগণ এই মর্মে অঙ্গিকারনামায় স্বাক্ষর করেছিলেন যে, মেয়ের প্রাপ্ত বয়স (১৮) না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের জন্য অপেক্ষা করবে উভয় পক্ষই।

কিন্তু স্থানীয় স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পড়–য়া কিশোরী রুমি (১৩) বেশ সুন্দরী হওয়ায় শিপন তার পিছু ছাড়েনি। বিভিন্ন লোভ-লালসা দেখাতে থাকে মেয়ে এবং তার পরিবারকে। রুমির বাবা আর্শাদ মিয়া একজন চায়ের দোকানদার। রুমিরা ৩ বোন, ২ ভাই। অভাবের সংসার তাদের। আর এই অভাবকে পূঁজি করেই তাদের নাবালিকা সুন্দরী মেয়ে এবং তার পরিবারকে নানাভাবে ফুসলিয়ে ৯ অক্টোবর ’১৫ ইং তারিখে বিয়ে করেন উপজেলার মোহাম্মদপুর (প.) ইউনিয়নের মালাখালা গ্রামের মৃত মোঃ নজরুল মিয়ার মালয়েশিয়া প্রবাসী পুত্র মোঃ শিপন মিয়া (৩৭)। সুকৌশলে গোপনে রুমির জন্মনিবন্ধন জাল করে ৩ লক্ষ টাকা দেনমোহর ধার্য্যরে মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করেন তারা।

প্রথমে বড় বড় লোভ ও ছলাকলা দেখালেও বিয়ের পর থেকেই শুরু হয় বালিকা বধু রুমির উপর শিপনের পরিবার থেকে নানা রকম নির্যাতন। একদিকে স্বামী শিপন বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপ দিকে থাকেন রুমিকে। আর অন্য দিকে শাশুড়ি ও দেবরসহ রুমিকে নানা ধরনের নির্যাতন চালাতে থাকে। রুমির বয়স কম হওয়ায় এ ধারাবাহিক নির্যাতন ও কাজের চাপ সহ্য করা সম্ভব হয় না। তারপরেও বাবা-মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার করতে বাধ্য হয় রুমি। কিন্তু সমস্যা আরো বড় হয়ে দেখা দেয় শিপনের ছোট ভাই মালয়েশিয়া প্রবাসী আল-আমিন বাড়িতে আসার পর। আল-আমিন সুন্দরী রুমিকে নানাভাবে যৌননির্যাতন করার জন্য দুর্ভিসন্ধি করতে থাকে। একসময় রুমিকে বিয়ের প্রস্তাবও দেয় সে। নিরুপায় হয়ে রুমি তার স্বামীকে ঘটনাটি জানান। স্বামী এই খবর পেয়ে মালয়েশিয়া থেকে দেশে আসেন। এর মাসখানেক পরেই এই অকল্পনীয় ঘটনাটি ঘটে।

১১ জানুয়ারি ’১৬ ইং। দিনটি ছিল বুধবার। ওইদিন সকাল ৯টায় আমরা কয়েকজন দাউদকান্দির বিভিন্ন গ্রামে হতদরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণে বের হই। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। শীতবস্ত্র বিতরণ শেষ পর্যায়ে। ঠিক এমন সময় খবর আসে, রুমি আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তাকে নাকি তার স্বামী ও পরিবারের লোকজন বিষপ্রয়োগ করে মেরে ফেলেছে! এখবর পেয়ে আমরা দ্রুত চলে যাই রুমির স্বামীর বাড়ি দাউদকান্দির মালাখালা গ্রামে। ওইখানে  যাওয়ার পর আমরা যা জানলাম, তা অবিশ্বাস্যই বলা যায়!  শিপনের মা জানান, ১১ জানুয়ারি বুধবার সকাল সাড়ে এগারোটায় নাকি রুমি এক ধরনের কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছে! কিন্তু প্রতিবেশিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায় অন্য তথ্য। প্রতিবেশিদের অনেকে মুখ খুলতে না চাইলেও কেউ কেউ স্পষ্ট জানিযে দিলেন যে, রুমিকে তারা প্রায়ই নির্যাতন করতো। বিশেষ করে বাচ্চা নেওয়ার জন্য তার স্বামী ও শাশুড়ি যারপরনাই যন্ত্র্র্রণা দিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই গ্রামের একজন ফেরিওয়ালা বলেন,‘ অত্র এলাকার মধ্যে এই পরিবারটি অত্যন্ত খারাপ প্রকৃতির। তারা কাউকে কেয়ার করে না। শিপনের বাবাও ছিলেন, মামলাবাজ এবং অতি চালাক প্রকৃতির। নানাভাবে এলাকার মানুষকে হয়রানি করাই ছিল তার কাজ। এমনি এক বৃদ্ধা মহিলাও বলে উঠেন,‘বাবারে রুমি মাইডা খুব ভালা আছিল। সব সময় আমাগরে সম্মান করতো। কিন্তু মাইয়াডা শান্তি পায় নাই। মাইয়াডারে এ পাষাণের দলেরা বাঁচতে দিলো না’।

রুমির মা বলেন, ‘দেড় বছর আগে আমার মেয়ের বিয়ে হয় মালয়েশিয়া প্রবাসী মোঃ শিপন মিয়ার সঙ্গে। বিয়ের পর ১ মাস ছুটি কাটিয়ে শিপন দেশের বাহিরে চলে গেলেও কয়েকদিন পরেই চলে আসে দেশে। তারপর আবার কয়েক মাস অতিবাহিত করে মালয়েশিয়া চলে যায় শিপন। এর মধ্যে শিপন রুমিকে বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপের উপর চাপ দিতে থাকে। এবার ১ মাস আগে শিপন বাড়ি আসে এবং রুমির উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালাতে থাকে। শুধু তাই নয়, শিপনের পরিবারও রুমিকে প্রায়ই নির্যাতন করতো। এরই মধ্যে রুমি নাকি অন্তসত্ত্বাও হয়। কিন্তু তারপরেও তাদের মন ভরেনি। শেষ পর্যন্ত আমার মেয়েটাকে ওরা মেরেই ফেললো’!

ঘটনার দিন আমরা সরেজমিনে গিয়ে দেখি, মালাখালার সর্দার বাড়িতে কিশোরী বধু রুমির মৃত দেহ পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে। চারদিকে মানুষের হাহাকার, কান্নার রোল। আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছে রুমির পরিবারসহ সাধারণ মানুষের কান্নার শব্দে। মানুষজন বলাবলি করছে, ‘এটা আত্মাহত্যা নাকি হত্যা? এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে কি করে এমন কাজ করতে পারলো পাষ-রা’!

রুমির বড় ভাই আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার বোন রুমিকে শিপন হত্যা করেছে। বিয়ের পর থেকেই রুমিকে তারা বাচ্চা নেওয়ার জন্য নির্যাতন করতো। আমরা এই হত্যাকা-ের উপযুক্ত বিচার চাই’।

এই মৃত্যুর ব্যাপারে দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই (তদন্ত কর্মকর্তা) জাহিদ হাসান বলেন,‘আমরা এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুমি’র লাশ উদ্ধার কওে ময়নাতন্ত্রের জন্য কুমিল্লা পাঠাই। এব্যাপারে দাউদকান্দি থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতন্ত’র রিপোর্ট হাতে এলেই এই ঘটনার রহস্য উদঘাটন হবে এবং কেউ দায়ি হয়ে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

মোহাম্মদপুর (প.) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মজিবুর রহমান বলেন,‘ ঘটনার দিন সকালে আমি জরুরি একটি কাজে ঢাকায় চলে যাই। তবে ঘটনাটি আমি ওইদিনই শুনেছি। তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যাবস্থা নেবেন পুলিশ প্রশাসন এটাই স্বাভািিবক। এরপরেও যদি উভয় পক্ষ আপোস-মিমাংসা করতে চায়-এটা তাদের ব্যাপার’। এদিকে এ ঘটনা ঘটার পরপরই শিপন ও তার ছোট ভাই আল-আমিন দূরে অবস্থান করছে।

পরের দিন অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে চারটায় দাউদকান্দি উপজেলার (প.) হুগুলিয়া গ্রামে মালাখালা গ্রামের এই কিশোরী বধু রুমির জানাজাা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়। জানাজার দিন দেখা যায়, বালিকা বধু রুমির অকাল মৃত্যুতে তার পরিবারে শোকের মাতম। রুমির মা ও বাবা বাকশক্তি হারিয়ে বোবা হয়ে গেছেন। তারা যেন মেয়ের শোকে পাথরমুর্তি ধারণ করেছেন। কুমিল্লা হতে রুমির লাশ হুগুলিয়া গ্রামে পৌঁছলে ওইখানের মানুষজন রুমির জন্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সবার মুখে মুখে একই কথা, ‘আহারে! নিষ্পাপ মেয়েটার এ কি অবস্থা হলো! মেয়েটা তো পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিল। কেনো তাকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হলো?’ ওই গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবার একই দাবি, ‘এই মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের যেন যথাযথ শাস্তি হয়। আর যেন কোন কিশোরীকে এভাবে অকালে পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে যেতে না হয়। কোন মা-বাবার বুক যেন খালি না হয় এমনি করে’।

ঘটনার পর থেকেই আমরা শিপনের মুঠোফোন-০১৮২২ ৫৬২১৪০-এ নম্বরে বারবার কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তার কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ১৭ জানুয়ারি সকালে ১০টায় তার মুঠোফোনে আবারও কল দেওয়া হলে তিনি কলটি রিসিভ করেন। এসময় শিপন বলেন, ‘আমি ভয়ে দূরে ছিলাম এবং কারো কল রিসিভ করিনি’। রুমির মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ আমি আমার বউকে খুব ভালবাসতাম। আমি কেনো তাকে মারবো। বাচ্চা নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলাম এটা সত্য। সাধারণ কথা নিয়ে রুমি বগার ঔষধ খেয়ে মারা গেছে’। বক মারার ঔষধ কোথায় পেলো রুমি? এ প্রশ্ন করার পর শিপন বলেন,‘আমি গত বছর সাচার বাজার থেকে জমির জন্য এনেছিলাম। জমিতে ব্যবহারের পর ঘরের মধ্যে কিছু ঔষধ ছিল। ওই ঔষধ খেয়েই রুমি মারা যায়। এখন রুমির বাবা-মা আমাকে বাঁচালেও পারেন এবং মারলেও পারেন। তাদের হাতেই সব কিছু’।

পরিশেষে আমাদের প্রশ্ন, এভাবে আর কত কিশোরির প্রাণ ঝরে যাবে অকালে? বাল্যবিয়ে থেকে কি পরিত্রাণ পাবে না কোমলমতি শিশুরা? এই কিশোরী রুমি কি অপরাধ ছিল? তাকে কেন হাতে ধরে বাল্যবিয়ের মত নরযন্ত্রণায় ঠেলে দেওয়া হলো? এর জন্য দায়ি কারা? এই মৃত্যুর রহস্য কি উদঘাটন হবে? নাকি আর দশটা ঘটনার মত এই মৃত্যুর ঘটনাও হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে? এর উত্তর পেতে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে কত দিন?