গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর বিদেশিরা বাংলাদেশে আসা কমিয়ে দেওয়ায় পর্যটন বছরেও খারাপ সময় পার করছে ঢাকার অভিজাত এলাকার হোটেলগুলো।
গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার পর বিদেশিরা বাংলাদেশে আসা কমিয়ে দেওয়ায় পর্যটন বছরেও খারাপ সময় পার করছে ঢাকার অভিজাত এলাকার হোটেলগুলো।
জুলাইয়ের প্রথম দিন গুলশানের ওই ঘটনার পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নির্ধারিত অনেক অনুষ্ঠান বাতিল করেছে, যেসব অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন হোটেল ও সম্মেলন কেন্দ্রে বুকিং ছিল।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৈরি পোশাক খাতের ক্রেতারাও বাংলাদেশে না এসে তৃতীয় কোনো দেশে তাদের আলোচনা সারতে চাইছেন।
গুলশান হামলার পর গত দেড় মাসে প্রায় ১০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ বাতিল করেছেন বলে জানিয়েছেন ট্যুর অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি তৌফিক উদ্দিন আহমেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অতিথিরা এসে হোটেলে থাকেন। তারা সফর বাতিল করায় আমরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে গেছি। আস্থা ফেরাতে ইতিবাচক প্রচার চালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সেবাখাতের অবদান ছিল জিডিপির ৫৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ; আর হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের অবদান ছিল জিডিপির ১ দশমিক ০৩ শতাংশ।
আগের বছরের পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, দুই খাতেই বাংলাদেশের আয় বাড়ছিল। এ দুটি খাতকে আরও এগিয়ে নিতে গতবছর এক অনুষ্ঠানে ২০১৬ সালকে ‘পর্যটন বছর’ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কিন্তু বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে গুলশান হামলার ঘটনা ‘হসপিটালিটি’ খাতের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে এসেছে।
হলি আর্টিজানের ঘটনায় জঙ্গিদের হাতে যে ২০ জনের মৃত্যু হয়, তাদের ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি নাগরিক।
ওই ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠেয় তিনটি আন্তর্জাতিক সভাও ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
হোটেল, গেস্টহাউজ অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা এলাকায় ৬০টি হোটেল-গেস্ট হাউজ রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোই কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে গুলশান হামলার পর।
গুলশানের ‘ব্যাটন রুজ’ রেস্তোরাঁ সারা বছরই ব্যস্ত থাকে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নানা আয়োজনে। সেখানে একসঙ্গে ৫০০ জন অতিথি নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর এক মাসে ব্যাটন রুজে নির্ধারিত একটি অনুষ্ঠানও হয়নি বলে ব্যবস্থাপক কামরুল হাসান জানান।
“গত ১০ বছর ধরে এখানে আছি। রোজার ঈদের পর থেকে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত নানা অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু এবার চিত্র উল্টো। জুলাই মাসে একটা অনুষ্ঠানও হয়নি। অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে মাত্র দুটো পার্টি হয়েছে।”
গুলশানের ঘটনায় ব্যবসার কতটা ক্ষতি হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পলিসির কারণে টাকার অংক বলতে পারছি না। তবে অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমে চার ভাগের একভাগ হয়ে গেছে।”
রোজার ঈদের পর থেকে কোরবানির ঈদের আগ পর্যন্ত ‘পিক সিজন’ থাকে। কিন্তু গুলশানের হামলা সব ‘ওলটপালট’ করে দিয়েছে বলে জানালেন লেইক শোর হোটেলের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. শরীফ মোল্লা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, হোটেলের ৬০টি কক্ষের প্রায় আশি শতাংশ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি, দাতাসংস্থা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে এদেশে আসা বিদেশি কর্মকর্তাদের জন্য ‘অকুপায়েড’ থাকত আগে। গুলশান হামলার পর তা ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে; বাতিল হয়েছে হলের বেশ কিছু রিজার্ভেশন।
“অগাস্টের ১২ ও ১৩ তারিখে দুটো কনফারেন্স হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো বাতিল হয়েছে। ঈদের পরে ব্যাংক, দাতা সংস্থা এবং করপোরেট অফিসের বেশ কিছু অনুষ্ঠান ছাড়াও কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে।”
বনানীর ৭ নম্বর সড়কের ‘গোল্ডেন টিউলিপ দ্য গ্রান্ডমার্ক’ হোটেলেও বুকিং কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালেদুর রহমান সানি।
“গুলশান হামলার আগে আমাদের হোটেলে অকুপেন্সি ছিল ৭০ ভাগ। অগাস্ট মাসের জন্য ৫০টা বুকিং ছিল। এর মধ্যে ৩০টা বাতিল করে দিয়েছে ক্লায়েন্টরা।”
রোজার ঈদের পর ঢাকা রিজেন্সি হোটেলে মানি লন্ডারিং ও টেলিযোগাযোগ বিষয়ে সম্মেলন এবং আমেরিকান দূতাবাসের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। এসব সম্মেলনের অতিথিদের জন্য ঢাকার বড় হোটেলগুলোতে ১২০০ কক্ষের রিজার্ভেশন নেওয়া হয়েছিল।
গুলশানের ঘটনার পর সম্মেলন বাতিল হওয়ায় রিজার্ভেশন বাতিল করা হয় বলে রিজেন্সির একজন কর্মকর্তা জানান।
একইভাবে জুলাই মাসে স্পেকট্রা কনভেনশন সেন্টারের অন্তত নয়টি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়।
গুলশান হামলার পর তৈরি পোশাক ক্রেতাদের অনেকগুলো বৈঠকও বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব বৈঠক তৃতীয় কোনো দেশে আয়োজন করতে ক্রেতারা অনুরোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাসির।
“অনেক বায়ার তাদের শিডিউল ক্যানসেল করে রিশিডিউল করছে। থার্ড কান্ট্রিতে যাওয়ার জন্য আমাদের বলছে।”
ক্রেতারা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি সার্বিক পরিস্থিতি বলছি। স্পেসিফিক বলতে পারব না। তবে অনেকে যাচ্ছে। আবার অনেক রিটেইলার, যাদের এখানে অফিস আছে, তারা এখানে আসছে, কাজ করছে।”