গুলশান হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়াদের একজন ভারতীয় নাগরিক সাত প্রকাশ। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আদালতের কাছে তিনি গত ২৬ জুলাই ১৬৪ ধারায় ইংরেজিতে লিখিত জবানবন্দি দেন। তার জবানিতে উঠে এসেছে হলি আর্টিজানে সেই রাতে জঙ্গিদের নারকীয় তাণ্ডবের চিত্র।
সাত প্রকাশ তার জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে আমি ভেতরেই ছিলাম। অপর এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দুই-তিনটি ছেলে ধাক্কাধাক্কি করে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে।এ সময় একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। পরে ছয়-সাতজন রেস্টুরেন্টের দিকে দৌড়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলির শব্দও শুনতে পাই। আল্লাহু আকবার বলে তারা শ্লোগান দেয়।
একজনকে কোপাতে দেখি
সাত প্রকাশ জবানবন্দিতে বলেন, হামলা শুরু হলে একটি পিলারের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজনকে রক্তাক্ত অবস্থায় মুখে হাত দিয়ে দৌড়াতে দেখি। তাকে দেখতে চীন, জাপান বা কোরিয়ার নাগরিক মনে হয়েছে। জানালা দিয়ে এক হামলাকারীকে দেখি ধারালো বস্তু দিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা একজনকে কোপাচ্ছিল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখি। কিছু সময় পর চোখ খুলে দেখি, পাশে থাকা শ্রীলঙ্কান দম্পতির দিকে তারা এগিয়ে আসছে। এসেই বলে লুকাবেন না। আরেকজন আমাদের কাছে মোবাইল চাইলো। আমি মোবাইল দিয়ে দিলাম। শ্রীলঙ্কান দম্পতি (নারী) ব্যাগ ছুড়ে দিলো, সেটি গিয়ে হামলাকারীর কাছে পড়লো। হামলাকারীরা জানতে চাইলো, আমি বাঙালি কিনা? আমি বললাম, ‘ইয়েস আমি বাঙালি’।
নারীরা বাঁচার জন্য আকুতি জানায়
সাত প্রকাশ তার জবানবন্দিতে আরও বলেন, হামলাকারীরা শুয়ে পড়তে বলে। আমি শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ওই শ্রীলঙ্কান দম্পতি তখনও দাঁড়িয়েছিলেন। তখন বন্দুকধারী এক হামলাকারী আমাকে ভেতরে চলে যেতে বললো এবং আমাকে বাংলাদেশি অন্য লোকজনের সঙ্গে বসতে বললো। তারা আমাকে টেবিলে মাথা রেখে চেয়ারে বসতে বাধ্য করলো। আমি পুরোপুরি মাথা টেবিলে ঠেকিয়ে রাখতে পারছিলাম না। তখন কেউ একজন আমার মাথায় আঘাত করে। নারীরা এক হামলাকারীর কাছে অনুরোধ করছিল তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। হামলাকারী জবাব দেয়, ‘আমাদের বিবেচনায় আপনারা যদি কাফের না হন, তাহলে আমরা আপনাদের কোনও ক্ষতি করবো না’। তারা বলে যে, ‘যারা কাফের নয় সেসব মানুষের কোনও ক্ষতি তারা করবে না।’
বেনজির আঙ্কেলকে বলো, আমি আটকে আছি
সাত প্রকাশ বলেন, হামলাকারীরা আমাদের মোবাইল ফোনের কল রিসিভ করতে বলে। আমি নিজের মোবাইল ফোন বন্ধ করে ফেলি। একজন হামলাকারী আমার কাছে জানতে চায়, মিডিয়ার কিংবা পুলিশের কাউকে আমি চিনি কিনা। আমি জবাব দেই ‘না’। এ কথা শুনে এক মেয়ে তার মাকে ফোন করে লাউড স্পিকারে কথা বলেন। তিনি তার মাকে বলেন, আম্মা তাড়াতাড়ি বেনজির আঙ্কেলকে বলো, আমি এখানে (গুলশান) আটকে আছি। মেয়েটির মা তখনও ওই ঘটনা সম্পর্কে জানতেন না। এরপর আরেকটি ফোন বেজে ওঠে। আমার সামনে বসা এক ব্যক্তি লাউড স্পিকারে কথা বলেন। (পরে আমি জেনেছি তিনি হাসনাত)। ফোনে তার বলা কথাগুলো আমি মনে করতে পারছি না।
সিঁড়ির গোড়ায় দেখি এক নারী পড়ে আছেন
এরপর তারা আমাদের পানি ও মাফিন খেতে দেয়।আমাদের তারা বাথরুম ব্যবহারও করতে দেয়। বাথরুমে যাওয়ার সময় আমি দেখি, সিঁড়ির গোড়ায় এক নারী পড়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখ ঢেকে ফেলি। কিছু সময় পর আমি শুনতে পাই, হামলাকারীরা রেস্তোরাঁর এক কর্মচারীকে বলছে, রান্নাঘরে যারা আছে তাদের দরজা খুলে বের হয়ে আসার কথা বলতে। হামলাকারীরা বাংলাদেশিদের হত্যা করবে না বলে ভেতরে থাকা ব্যক্তিদের আশ্বস্ত করেছিল ওই কর্মচারী। এরপর হামলাকারীরা কয়েকবার চেষ্টার পর রুম খুলে ফেলে। ভেতরে দুই ব্যক্তিকে পাওয়া যায়। দুজনের একজন ছিলেন রেস্তোরাঁর এক কর্মচারী ও অন্যজন ছিলেন জাপানি।
কোপাতে কোপাতে বলে মহিলা মরতেছেনা
হামলাকারীরা রেস্তোরাঁর এক কর্মচারীকে অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে বসতে দেয় এবং জাপানি নাগরিককে গুলি করে। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, ওই জাপানি বেঁচে আছেন কিনা। জাপানি ব্যক্তি জবাব দেন, ‘হ্যাঁ’। হামলাকারী আবার তাকে গুলি করে। গুলি করার আগে তারা আমাদের কানে হাত ও শিশুদের চোখ ঢেকে দিতে বলে। এক সময় আমি এক নারীর গোঙানির শব্দ শুনতে পাই। কোপাতে থাকা ব্যক্তিটি বলছিল ‘মহিলা মরতেছে না’।
তারা মোবাইল,ট্যাব,ল্যাপটপ ব্যবহার করেছিল
আমি তাদের দেখি, দুটি বড় গ্যাস সিলিন্ডার কাঁচের দরজার দুপাশে রাখতে। তারা মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ ব্যবহার করেছিল। তারা মোবাইল ফোন থেকে খবর পড়ে হাসছিল এবং জোরে জোরে বলছিল, ‘তারা আমাদের সন্ত্রাসী বলছিল, এখন আমাদের জঙ্গি বলছে। আগামীকাল আমাদের কী বলবে তারা জানেই না’। এক পর্যায়ে তারা (হামলাকারী) আমাদের বাংলায় একটি বার্তা (মেসেজ) পড়ে শোনায়। তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে এ বার্তা পাঠানো হয়। বার্তাটি অনেক দীর্ঘ ছিল। সবটা আমার মনে নেই। তবে আমার মনে আছে এতে বলা হয়েছে, তারা খুব বড় কাজ করেছে, এ জন্য তাদের ভাইয়েরা তাদের নিয়ে গর্বিত। এরপর তারা সেহরি খেতে দেয়। তাদের সন্দেহ এড়াতে আমি কয়েক কামড় খাই।
আমরা রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করি
সেহরির পর তারা আবারও আমাদের টেবিলে মাথা রাখতে বলে। আমার আবছাভাবে মনে পড়ে, কেউ একজন নির্দেশনা দিচ্ছিল। দুই ব্যক্তি (হামলাকারী) থাকবে ওপরের সিঁড়িতে, দুজন থাকবে সিঁড়ির নিচের দিকে। একজন কিছু একটা করবে যা আমার মনে পড়ছে না। পরে তারা দুই ব্যক্তিকে তাদের (হামলাকারীদের দিকে) কাছে আসতে বলে। আমি তাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখি। কিছু সময় পর তারা ফিরে আসেন এবং আমার সামনে টেবিলে মাথা নিচু করে বসেন। এ সময় আমি একমাত্র হামলাকারীকে চলাফেরা করতে দেখি। আমি দেখি, টাক মাথার ব্যক্তি (হাসনাত) সামনের দরজা খুলছেন। আমি বাকি সবার সঙ্গে উঠে দাঁড়াই এবং তারা আমাদের ছড়িয়ে পড়তে বলে। হঠাৎ আমি দেখি, এক ব্যক্তি (হামলাকারী) তাহমিদকে পবিত্র কোরআন শরিফ দিচ্ছে। কিন্তু তাহমিদ তা নিতে অস্বীকৃতি জানান। আমি তা (কোরআন) নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তারা আমাদের ফোন (টেবিলে ওপর রাখা) ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়। আমরা রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করি।