কওমী মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষাদানের বিষয় ও পদ্ধতি ঠিক করতে প্রায় চার বছর আগে গঠিত কমিশনের কাজ ‘দ্রুত’ শেষ করে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এক কারিকুলাম ও সনদের আওতায় আনার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক ‘উলামা সম্মেলনে’ তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এর সময়টা আমরা বৃদ্ধি করে দিয়ে, যদি আরও কিছু সদস্য নিতে হয় তাদেরকে নিয়ে, এই কাজটা খুব দ্রুত করা দরকার।
“আমি খুব তাড়াতাড়ি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব, আমাদের ধর্মমন্ত্রীও এখানে আছেন, আমি বলব এই উদ্যোগটা নিতে।”
কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাদানের বিষয় এবং কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতির লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নে ২০১২ সালের এপ্রিলে ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা হলেও মাদ্রাসা পরিচালনাকারীদের একটি অংশের বিরোধিতার কারণে সে প্রক্রিয়া থমকে যায়।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় পড়ছে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী। কমিশনের কাজ শেষ না হওয়ায় দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা এসব মাদ্রাসা কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
শেখ হাসিনা বলেন, কওমী মাদ্রাসার জন্য পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের সনদ দিতে ওই কমিশন গঠন করা হলেও পাঁচ বোর্ডে বিভক্ত মাদ্রাসাগুলোর পরিচালকরা একমত হতে পারেননি। “আমরা আশা করি, এখন যখন আমাদের ধর্মের ওপর এতবড় আঘাত এসেছে, এই সময় সকলের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এসব কওমী মাদ্রাসা জঙ্গিবাদের সূতিকারগার হয়ে উঠছে বলে বিভিন্ন সময়ে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। গত কয়েক বছরে জঙ্গি হামলা ও হত্যাকাণ্ডের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে গ্রেপ্তার অনেকেই এসব মাদ্রাসার ছাত্র।
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় থেকে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ সরকার কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) সভাপতি ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামীর আমীর শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করে।
ওই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান হন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। সদস্য সচিব করা হয় গোপালগঞ্জের গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূহুল আমীনকে। কিন্তু এই দুই জনকে সরকারসমর্থক বলে অভিযোগ করেন কমিশনের অন্য আলেমরা।
পরবর্তীতে কো-চেয়ারম্যান-১ পদে মাওলানা আশরাফ আলীকে ও সদস্য সচিব পদে আবদুল জব্বারের নাম দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করার দাবি জানান আহমদ শফী।
সেই সঙ্গে বেফাকের নামে কওমী সনদের স্বীকৃতি দেওয়া, বেফাককে অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় করা, সরকারি অনুদান গ্রহণ না করা ও কওমি মাদ্রাসার পাঠপদ্ধতি পরিবর্তন না করাসহ আটটি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।
সরকারের সঙ্গে দুটি বৈঠকের পরেও এসব দাবি পূরণ না হওয়ায় আহমদ শফী কাউকে কিছু না জানিয়ে কমিশন থেকে ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়েন। পরে কমিশন তাদের প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়।
২০১৩ সালের ৯ মার্চ শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশজুড়ে সংগঠিত হয়ে ওই বছরের ৬ এপ্রিল লংমার্চ ও ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম।
মতিঝিলে হেফাজতের তাণ্ডবের পর ওই বছরের শেষ দিকে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু এনিয়ে হেফাজতে ইসলাম দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিলে পিছু হটে সরকার।
সরকার আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করায় কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষা এবং দেশে-বিদেশে চাকরির সুযোগ পাবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারাই একমত হতে চান, তারাই একমত হন। আমরা এটা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে পারি। “তাহলে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা সনদ দিতে পারব।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শেখ হাসিনা বলেন, “সনদ দিতে হলে একটা মিনিমাম কারিকুলাম লাগবে। না হলে কীসের ভিত্তিতে শিক্ষা হবে, কীসের ভিত্তিতে সনদটা দেবেন?”
‘ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এ উলামা সম্মেলনে সবার সহযোগিতা চেয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “এই সময় এটা খুব দরকার। যাতে কারিকুলামটা প্রণয়ন করে দ্রুত আমরা সনদ দেওয়ার কাজ শুরু করতে পারি।”
কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা আয়োজিত এ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান ও শোলাকিয়ার ঈমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদও বক্তব্য দেন।
‘কোন ধর্ম তারা পালন করছে’
ধর্মের নামে যারা মানুষ হত্যা করছে, তাদের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “নিরীহ মানুষ, সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। আর হত্যা করলেই নাকি তারা বেহেস্তে চলে যাবে, হুর পাবে। এটা কোন ধরনের কথা! এটা তো ইসলামের শিক্ষা হতে পারে না।”
কোরআন থেকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, “কোরআন শরীফই বলে দিচ্ছে তোমরা সন্ত্রাস ও দুযোগ সৃষ্টি করো না। তারা সন্ত্রাস ও দুর্যোগ সৃষ্টি করে কোরআনের বাণীকেই অস্বীকার করছে। কোন ধর্ম তারা পালন করছে?” জঙ্গি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারাদেশে যে জনমত সৃষ্টি হয়েছে, সেই চেতনাকে আরও ‘শানিত’ করার ওপর গুরুত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী।
“এ দায়িত্ব আমরা আমাদের পক্ষ থেকে করে যাচ্ছি। এবং আপনারা যারা ধর্ম শিক্ষা দেন এবং ধর্মের কথা বলেন, আপনাদের আরও ভালভাবে মানুষকে বোঝাতে হবে।”
শেখ হাসিনা জানান, কেউ যাতে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিপথে না নিতে পারে সেজন্য প্রতিটি উপজেলা ও জেলায় একটি করে মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
“আজকে কয়েকটা লোকের জন্য এই পবিত্র ধর্ম হেয় প্রতিপন্ন হবে- এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য না।”
বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করলেও প্রত্যেকে ভিন্ন ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করে, বিপদে আপদে রক্ষা করে।
“এটা হচ্ছে এদেশের মানুষের সব থেকে বড় অর্জন।”
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, “কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী, বিভ্রান্ত ও সন্ত্রাসী ইসলামকে ব্যবহার করে মারামারি, হানাহানি ও কাটাকাটি করছে।”
এক লাখের বেশি আলেমের সমর্থন নিয়ে ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়ার’ কথাও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তিনি।
এই ফতোয়া সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চান শোলাকিয়ার ইমাম।
শেখ হাসিনা ওই ফতোয়াকে একটি ‘মহৎ’ উদ্যোগ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “আপনাদের মহান উদ্যোগের ফলে আমাদের ইসলাম ধর্মের মান-সন্মান আবারও ফিরে আসবে, বৃদ্ধি পাবে। এটা বিশ্বব্যাপী যাতে প্রচার হয় সে ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা আমরা নেব।”