ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, রোববার ২৭ এপ্রিল ২০২৫ || বৈশাখ ১৪ ১৪৩২ :
সারা দেশেই এখন আলোচিত বিষয় ব্যাটারিচালিত রিকশা। সড়কে নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল ও অনিরাপদ কাঠামোর কারণে তিন চাকার এই বাহন নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেকেই। তারা চান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বা অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করা হোক। অন্যদিকে কম ভাড়া ও বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মস্থানের কারণ দেখিয়ে কেউবা অটোরিকশা চলাচলের পক্ষে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক নকশা তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বুয়েটের এই নকশা অটোরিকশাকে কিছুটা নিরাপদ বানালেও চালকের অদক্ষতার কারণে তা কাজে আসবে না। তারা বলছেন, অটোরিকশার নতুন নকশার চেয়ে এর নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি। তা না হলে কখনোই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে না। তবে অটোরিকশার নতুন নকশায় সোলার প্যানেল যুক্ত করা হলে দেশের বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো।
প্রচলিত অটোরিকশার কী সমস্যা ছিল:
বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের দেশে প্রচলিত অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো এর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এর গতির তুলনায় ব্রেকিং সিস্টেম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এছাড়া এসব অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির জীবনকাল খুব বেশি নয়। অর্থাৎ ব্যাটারিগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। এসব ব্যাটারি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।
তারা বলেন, আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যাটারিচালিত রিকশার নকশা অন্যান্য পায়ে টানা সাধারণ রিকশার মতোই। সমস্যা হচ্ছে সাধারণ রিকশার ডিজাইন দ্রুত গতিতে চলার উপযোগী নয়। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো হচ্ছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে অনেক সময়। এসব বাহন দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে যায় অনেক সময়; বেশি গতির কারণে বাঁক নেয়ার সময়ও উল্টে যেতে পারে। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে ব্রেক কষে থামতে না পারার কারণে অন্য গাড়ি বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।

দুর্বল কাঠামোর কারণে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনার শিকার হয় প্রচলিত অটোরিকশা: ছবি চ্যানেল 24
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রায় ৩০ ধরনের অটোরিকশা চলে। সেগুলোর কোনোটি ৩ জন যাত্রী পরিবহন করে, কোনোটিতে আবার ৮ জন যাত্রীও নেয়া হয়।কিন্তু এসব অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।
ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ব্রেকিং সিস্টেম এমন অভিমত হাদিউজ্জামানের। বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, ‘সাইকেলে বা রিকশাতে আমরা যে ব্রেক দেখি তা হলো ‘ইউ’ ব্রেক। এই ব্রেকে চাকার দুই পাশে দুটি ব্রেক প্যাড থাকে, যা রিমকে চাপ দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম, ভেজা চাকায় এই ব্রেক খুবই কম কাজ করে। এছাড়া এসব রিকশার কাঠামো ও চাকা অনেক দুর্বল, দ্রুত গতিতে চলাচলের উপযোগী নয়।”
বুয়েটের নকশা করা অটোরিকশায় কী সুবিধা:
নকশা করা অটোরিকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য যোগ করেছেন বুয়েটের প্রকৌশলীরা। নতুন নকশার এই রিকশার দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ২ মিটার, প্রস্থ দেড় মিটার এবং উচ্চতা ২ দশমিক ১ মিটার। এটি ৩২৫ থেকে ৪২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন বহনে সক্ষম। এছাড়া নতুন রিকশায় ব্রেকিং ব্যবস্থা প্রচলিত অটোরিকশার চেয়ে অনেক ভালো বলে দাবি করেছেন প্রকৌশলীরা। তারা জানান, নতুন নকশার অটোরিকশায় তিনটি চাকায় ‘হাইড্রোলিক ডিস্ক ব্রেক’ ও বিকল্প ‘পার্কিং ব্রেক’ সংযোজন করা হয়েছে। ফলে রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। এছাড়াও নতুন রিকশায় লুকিং গ্লাস, ইন্ডিকেটর, ছাউনি, কাঁচের উইন্ডশিল্ড থাকবে। ফলে বৃষ্টিতে চালক ও যাত্রীদের ভিজতে হবে না। নতুন রিকশায় কাঠামোর সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত করা হয়েছে হেডলাইট । হেডলাইটে ‘হাই বিম’, ‘লো বিম’ ও ‘ডিআরএল’ (ডে টাইম রানিং ল্যাম্প) যুক্ত করা হয়েছে। নতুন নকশার এই রিকশাটি তৈরিতে দেড় লাখ টাকার আশপাশে খরচ হতে পারে বলে দাবি করেছেন প্রকৌশলীরা।
এছাড়াও নতুন নকশার অটোরিকশার ব্যাটারি একবার চার্জ দিলে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরত্ব পারি দেয়া সম্ভব হবে। এর সর্বোচ্চ গতি ওঠানো যাবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার।
Advertisement
অটোরিকশার নতুন নকশা নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা:
অটোরিকশার নতুন নকশার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, নতুন নকশায় বাহন হিসেবে এটা কিছুটা নিরাপদ হলো সেটা এক বিষয়, আর সড়কের শৃঙ্খলার বিষয়টা অন্য। বাহনটি বিজ্ঞানস্মত হলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে বিষয়টি তা নয়।
তিনি বলেন, বুয়েটের প্রকৌশলীরা আমাদের দেশে প্রচলিত ১২ ধরনের অটোরিকশা পর্যালোচনা করে এর ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করেছেন। এটা একটা ইতিবাচক দিক, কারণ আগেতো বুঝতে হবে এর সমস্যাগুলো কোথায়। এরপর তারা নতুন ডিজাইনের অটোরিকশায় ১৬টি বিষয় যুক্ত করেছে এটাকে যান্ত্রীকগত ও কাঠামোগতভাবে পরিপক্ক করার জন্য। নতুন যুক্ত করা এই বিষয়গুলোর জন্য আমাদের প্রচলিত রিকশার চেয়ে অনেক মজবুত ও নিরাপদ হবে। এই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
বুয়েটের এই অধ্যাপক আরও বলেন, তবে নতুন নকশার এই রিকশাগুলো আমরা যখন বাণিজ্যিকভাবে সড়কে নামাবো তখন আগের রিকশাগুলো কতদিনের মধ্যে সড়ক থেকে তুলে নিতে পারবো, কিংবা আদৌ তুলতে পারবো কিনা সেটা কিন্তু একটা পলিসিগত বিষয়। সেই সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। যদি পুরাতনগুলো আমরা তুলে নিতে না পারি তাহলে নতুনগুলো নামিয়েও সড়ক নিরাপদ করা যাবে না।
তিনি বলেন, রিকশার কাঠামোসহ যান্ত্রিক বিষয়গুলো শুধু উন্নত করলেই হবে না, একই সঙ্গে এর চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ চালক দক্ষ না হলে যানবাহনের কাঠামো বিজ্ঞানভিত্তিক করে সড়ক নিরাপদ করা যাবে না। অদক্ষ চালকের হাতে পড়লে রোলসরয়েসও অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। তাই সবচেয়ে জরুরি চালকদের দক্ষ করে তোলা।
ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর বিচরণক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ। অটোরিকশার কাঠামো যতই বিজ্ঞাভিত্তিক হোক না কেন, এটাকে কোনোভাবেই প্রধান সড়ক বা যেসব সড়কে গণপরিবহন চলাচল করে সেখানে এটার বিচরণ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে নিরাপদ সড়কের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। সড়কে শৃঙ্খলার জন্য অটোরিকশার বিচরণক্ষেত্র ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। একই সঙ্গে চালকের দক্ষতা ও লাইসেন্স নিশ্চিত করতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে একটা সমন্বিত নীতিমালা লাগবে।
তিনি বলেন, অটোরিকশার নতুন নকশায় এটার যান্ত্রিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন করা হয়েছে। একই সঙ্গে আরেকটা বিষয় দেখা উচতি, সেটা হলো বিদ্যুৎ। যেহেতু আমাদের দেশে বিদ্যুসঙ্কট রয়েছে, সেহেতু অটোরিকশার নতুন নকশায় সোলার প্যানেল যুক্ত করা যায় কিনা সেটা প্রকৌশলীদের ভেবে দেখা উচিত। যদি অটোরিকশার কার্যক্ষমতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রেখে এর সঙ্গে সোলার প্যানেল সংযুক্ত করা যায় তাহলে অনেক ভালো হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, অটোরিকশার নিরাপদ নকশার নামে আমরা আমাদের মূল সমস্যা রেখে অন্যদিকে চলে যাচ্ছি বলে আমার মনে হয়। অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো সংখ্যাগত ও বিচরণক্ষেত্র।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে যানবাহনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ সীমিত। পিক টাইমে সড়ক থেমে যাচ্ছে, অ্যাম্বুলেন্স যেতে পারছে না। এরইমধ্যে সড়কে ছোট গাড়ির সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ছোট গাড়িকে আমরা কত আধুনি, কত নিরাপদ আর কতটা স্বস্তা করলাম, এই ইস্যুটা যারা তুলছেন তারা সড়কের আসল রোগটাই ধরতে পারেননি।
বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, সীমিত সড়কে ছোট যানগুলো চলার কিংবা থামার জন্য যতটা জায়গা নিচ্ছে সেটাই হচ্ছে যানজটের জন্য বড় হুমকি। আগে কিংবা বর্তমানে ঢাকার জন্য বড় বিরম্বনা যেমন অটোরিকশা, তেমনি ভবিৎষতে নতুন এই ছোট যানগুলোও হবে আরও বড় বিড়ম্বনা। অন্যদেশগুলো সড়ক থেকে ছোট গাড়ি সরিয়ে বড় গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়েছে। সেখানে আমরা ছোট গাড়ি নিরাপদ করার কথা বলছি। ছোট গাড়ি নিরাপদ করলে সড়ক নিরাপদ হবে না। সড়ক নিরাপদ করার জন্য প্রয়োজন ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ।
Advertisement
তিনি বলেন, আরেকটা কথা বলা হচ্ছে যে এগুলো নিবন্ধনের আওতায় আনবো। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে কে নিয়ন্ত্রণ করবে এটাকে? আগে রিকশা নিবন্ধনের আওতায় এনেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু নিবন্ধন দিয়েতো রিকশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উল্টো পঙ্গপালের মতো বেড়েছে। এখন সেটাই হয়ে গেছে মাথাব্যথার কারণ। সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় কোনোভাবেই রিকশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। উল্টো রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে চালকরা সড়ক আটকে আরেক বিরম্বনা তৈরি করে। সড়কে যত ছোট গাড়ি তত বেশি চালক। আর যত বেশি চালক ততবেশি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই আমার মনে হয় অটোরিকশাকে নিরাপদ করে যারা সড়কে নামানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তারা আসলে ঢাকাকে ডোবানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ছোট ছোট গাড়িগুলোকে রিপ্লেস করতে হবে বড় গাড়ি দিয়ে। পুরো পৃথিবীই তাই করেছে।
বুয়েটের করা নকশায় ব্যাটারিচালিত রিকশা -সংগৃহীত ছবি