যে কারণে বন্ধ হয়ে গেল ‘ফুড ভিলেজ’ (ভিডিও)

SHARE

https://www.facebook.com/share/p/1AQ3ACNQdG/

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি), ‘ফুড ভিলেজ’প্রতিনিধি, শুক্রবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩২  :

বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় অবস্থিত হোটেল ফুড ভিলেজ প্লাস। উত্তরের যাত্রীদের কাছে এটি ফুড ভিলেজ নামেই পরিচিত ছিল। ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে গতকাল সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে হোটেলটি স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

বন্ধ ঘোষণা করার পর ইতোমধ্যেই হোটেলটির সামনে কাজ শুরু করে দিয়েছে সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২)। হোটেল কর্তৃপক্ষও মালামাল সরানোর কাজ শুরু করেছে। সরিয়ে নেওয়া হয়েছে হোটেলটির সামনে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা ছোট ছোট দোকানগুলো। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ২ দশমিক ৬৭ একর জায়গা লিজ নিয়ে হোটেলটি তৈরি করেছিল কর্তৃপক্ষ।

মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে হোটেলটিতে গিয়ে দেখা যায়, চিরপরিচিত সেই জায়গাটি এখন অনেকটাই নীরব। নেই দূরপাল্লার পরিবহনের চাপ। দেখা যায়নি শত শত যাত্রীদের আনাগোনা। নেই ফুড ভিলেজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেই ৫০-৬০টি পান-সিগারেট, চিপস-পানীয়র দোকান। বরং সেখানে এখন ভাঙাচোরার কাজ করছে সাসেক। ভেতরে ঢুকতেই আর চোখে পড়ল না সেই আগের দৃশ্য। যে চেয়ার-টেবিলগুলোতে যাত্রীরা বসে খাবার খেতে ব্যস্ত থাকতেন সেগুলো এখন পড়ে আছে এলোমেলো। কিছু চেয়ার-টেবিল আবার সরিয়ে রাখা হয়েছে একদিকে। নেই শ্রমিকদের উপস্থিতি। ব্যস্ততম এই হোটেলটির ভেতরে বিরাজ করছে শুনশান নীরবতা।

হোটেলটির সামনে দোকান ছিল ইমরান খান নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হুট করেই ফুড ভিলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দোকানগুলো সরিয়ে নিতে হয়েছে। এখানে আমারও একটি দোকান ছিল। এখন আর আমারও ব্যবসা বন্ধ। কে কোথায় আছে জানি না। তবে সবাই কোনো না কোনো কর্ম করে খাবে ইনশাআল্লাহ।

হোটেলটির দ্বিতীয় তলায় উঠতেই দেখা মিলল এক নিরাপত্তাকর্মীর। সেখানেই কথা হয় হোটেলটির নিরাপত্তাকর্মী আমজাদ হোসেনের সঙ্গে। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে মাত্র দুমাস আগেই এখানে চাকরি নিয়েছেন তিনি।

আমজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের উন্নয়ন কাজের এরিয়ার মধ্যে পড়ায় হোটেলটি বন্ধ হয়ে গেল। সেই সঙ্গে গেল চাকরিও। আগামীতে কোথায় চাকরি পাব বা কী করবো জানি না। এখনো বেতন না পেলেও দু-এক দিনের মধ্য কর্তৃপক্ষ বেতন দিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে।

হোটেলটির ওয়েটারদের ক্যাপ্টেন হিসেবে কাজ করতেন আকরাম হোসেন। সেখানে দেখা মিলল তারও। তিনি এখানে হোটেলটির শুরু থেকেই ছিলেন। হোটেলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছেন জানিয়ে আকরাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই ছিলাম। এখন সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য হোটেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

তবে তাকে ফুড ভিলেজের বগুড়ার শেরপুর শাখায় কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের যে আরেকটা শাখা আছে সেখানে কাজ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওটা দূরে হওয়ায় যাব কিনা  এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তবে ইতোমধ্যেই বেতন পেয়েছেন বলে জানান এই কর্মচারী।

বিদায়বেলায় কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন সেখানকার পরোটার কারিগর আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ফুড ভিলেজ প্লাসের শুরু থেকেই ছিলাম। আজ বিদায়বেলায় ফুড ভিলেজের মায়া ত্যাগ করতে পারছি না। এখন সরকারের ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার ৭০০ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ল। অনেকের কর্ম ধরতে অনেক সময় লাগবে। এখানে আমরা সবার সঙ্গে মিশেছি। এখন সেইসব মায়া ত্যাগ করতে পারছি না।

করোনার মাঝে তাদের বসিয়ে রেখেও বেতন দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে রাজ্জাক বলেন, আমরা করোনার সময় কাজ না করেও বেতন পেয়েছি। কোম্পানি খুবই ভালো। আমরা দোয়া করি কোম্পানি যেন আমাদের জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে এবং আমাদের যেন আবার সেখানে কাজের সুযোগ করে দেয়।

ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলের সিনিয়র উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. শাহজাহান রেজা সাগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, টানা ১০ বছর সেবা দেওয়ার পর আজ ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে হোটেলটি বন্ধ করে দিতে হলো। আসলে ফুড ভিলেজ প্লাস হোটেলটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে একটা সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান। এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হয়তো অনেকেরই মন খারাপ হবে, সমস্যা হবে, কিন্তু আমাদেরও কিছু করার ছিল না। এখন হাটিকুমরুল এলাকায় আর দূরপাল্লার ভালো বাসগুলোর যাত্রাবিরতি দেওয়ার তেমন কোনো জায়গাও থাকলো না।

তিনি বলেন, আমাদের বগুড়ার শেরপুরে আরেকটি ফুড ভিলেজ হোটেল থাকায় কিছু কর্মচারীকে সেখানে শিফট করা হচ্ছে। বাকিদেরও তালিকা করে রেখে দেওয়া হচ্ছে। যাতে আগামীতে কাজের সুযোগ হলেই তাদের কর্মের ব্যবস্থা করা যায়। হোটেল ফুড ভিলেজ প্লাসে পাবনা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও বগুড়াসহ আরও কিছু জেলার বাস যাত্রাবিরতি দিত বলেও জানান তিনি।

শাহজাহান রেজা সাগর বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত অন্য কোথাও যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। কোথাও কোনো জায়গা এখনো পাওয়া যায়নি। বিষয়গুলো নিয়ে সাসেক প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। আমরা নলকা ব্রিজের আশপাশে ভালো কোনো জায়গা পেলে সেদিকে যেতে পারি। এখন পর্যন্ত আমাদের এমনই চিন্তাভাবনা আছে।

সাসেক-২ এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক মাহবুব রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে তাদের হোটেলের জায়গাটা সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। তারপরও তারা যেতে চাচ্ছিল না। কিন্তু তাদেরকে অনেক বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে সক্ষম হয়েছি। এরপর তারা হোটেলটি বন্ধ করে দিয়েছে। হোটেলটির সামনের জায়গায় ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেছে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যেই হোটেলটি ভাঙা হবে।

সিরাজগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী সফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফুড ভিলেজ প্লাসকে ২ দশমিক ৬৭ একর জায়গা ২০১৩ ও ২০১৮ সালে দুই মেয়াদে ৫ বছর করে মোট ১০ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালে লিজ মূল্য ছিল ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৪০ টাকা। তবে ঢাকা অফিস থেকে তারা লিজ নেওয়ায় আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারছি না। এ ছাড়াও ফুড ভিলেজ করার আগে সেখানে কী ছিল এটাও বলতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, তারা জায়গাটি নিয়ে মামলা করায় আমরা তেমন কিছু করতে পারছিলাম না। এদিকে ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পে জায়গাটি প্রয়োজন হওয়ায় সরকার অধিগ্রহণের কাজও সম্পন্ন করেছে। এখন সেখানে সাসেক তাদের প্রকল্পের কাজ করবে।

Advertisement

প্রসঙ্গত, এসআর গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান হলো হোটেল ফুড ভিলেজ প্লাস। ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন এসআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য জি.এম সিরাজ। সেদিন থেকে বাণিজ্যিকভাবে পথচলা শুরু করে ১০ বছর পর ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ ও হাটিকুমরুল গোলচত্বর এলাকায় হতে যাওয়া ইন্টারচেঞ্জ প্রকল্পের কারণে গতকাল সোমবার বন্ধ করে দেওয়া হয় হোটেলটি।