মানুষ জিম্মি করে রাজপথে নৈরাজ্য

SHARE

ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ  প্রতিনিধি,বুধবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৫ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩২  :

কথায় কথায় সড়ক অবরোধ। ইচ্ছা হলেই বিক্ষোভ। ক্ষুব্ধ হলেই গাড়ি ভাঙচুর। এমনই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলছে, আর নৈরাজ্যকারীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যানজটে বসে থাকার আশঙ্কা নিয়ে ঘর থেকে বের হন সাধারণ মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে আটকেও থাকতে হয়। প্রতিদিন রাজধানীর রাস্তায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন কাজে নামা মানুষ। সরকারের নমনীয়তায় মানুষকে জিম্মি করে দাবি আদায়ে নৈরাজ্যের মোচ্ছব তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

Advertisement

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বিভিন্ন সংগঠন, পেশাজীবী, ছাত্র-শ্রমিক বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেন। প্রায় প্রতিদিন দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথ দখল করা হচ্ছে। আনসার, শিক্ষক, চাকরিজীবী,

চাকরি ও চিকিৎসা প্রত্যাশী থেকে শিক্ষার্থী পর্যন্ত নানা দাবি নিয়ে মাঠে নামেন। কয়েকদিন বিরতি মিললেও গত সপ্তাহে পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজপথ বন্ধ করে দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু করে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম

চৌধুরী বলেছেন, মব জাস্টিস আর অ্যালাউ (অনুমোদন) করা যাবে না। অনেক হয়েছে। কারও কোনো কিছু বলার থাকলে আইনের আশ্রয় নেবে।

জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা কোনো বড় ধরনের কারণ ছাড়াই সড়ক অবরোধ করে গাড়ি ভাঙচুর করে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তারা সংঘর্ষে জড়ায়। শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধের রেশ না কাটতেই হজরত মোহাম্মদকে (স.) কটূক্তির অভিযোগে গতকাল তেজগাঁওয়ের একটি শিল্পগোষ্ঠীর কর্মচারীরা সড়ক অবরোধ করে। তাদের সঙ্গে আশপাশের লোকজনও যোগ দেয়। সন্ধ্যার পর লাঠিচার্জ করে রাস্তা থেকে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল রাজধানীর নতুনবাজার থেকে বাড্ডা সড়কের এক পাশে রাস্তার ওপরই ময়লা-আবর্জনা ফেলে প্রতিবাদ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এর ফলে যান চলাচলের জায়গা সরু হয়ে যাওয়ায় সড়কে তীব্র যানজট তৈরি হয়। বর্জ্যরে গন্ধে আশপাশের মানুষের নাভিশ^াস ওঠে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর কেউ কেউ মানুষকে জিম্মি করে বেকায়দায় ফেলে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছে। দাবি আদায়ে রাজধানীতে কয়েকশ মিছিল ও বিক্ষোভ হয়েছে। ন্যায্য দাবিগুলো পর্যায়ক্রমে মেনে নেওয়া উচিত। আবার দাবি-দাওয়ার মধ্য দিয়ে কেউ হীন স্বার্থ হাসিল করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, দাবি আদায়ে জিম্মি করে বাধ্য করার যে সংস্কৃতি আছে, সেটা পরিবর্তন করতে হবে। দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামার আগে টেবিলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের দিকে নজর দেওয়া উচিত। যুক্তির নিরিখে পর্যায়ক্রমে দাবি পূরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। দাবি আদায়ে ভোগান্তি তৈরি করলে মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার সায়েন্সল্যাব মোড়ের কাছে এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের ক্যাম্পাস। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছরই কয়েকবার করে সংঘর্ষে জড়ায় নানা কারণে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি কথা কাটাকাটির জেরে সায়েন্সল্যাব এলাকাতেই সংঘর্ষে জড়ায় সিটি কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে সেদিন ১৮ জন আহত হয়। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওই দিন আইডিয়াল কলেজের নামফলকও খুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়। এর পাঁচ দিন পর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজের একটি বাস ভাঙচুর করে আইডিয়ালের শিক্ষার্থীরা। গত ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজের ১৮৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন দুপুরে কলেজের দুটি বাস সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ভাঙচুর করে। এ ঘটনার জেরে দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই মারামারি চলে, যাতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এরপর ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ ও বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের প্রতিনিধিসহ পুলিশের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এর মধ্যে আবার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা।

Advertisement

এ ব্যাপারে সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোবারক হোসেন বলেন, বিভিন্ন ধরনের ফেসবুক গ্রুপ আছে, সেখানে তারা একে অপরকে কটাক্ষ করে। ওইসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি হয়। শেষ পর্যন্ত এটা বড় আকার ধারণ করে।

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনের অধিকার সবার রয়েছে। তবে জনগণকে জিম্মি করে যেন আন্দোলন করা না হয়। এ ছাড়া সরকারের আহ্বান থোড়াই কেয়ার করছেন আন্দোলনকারীরা। জানমালের ক্ষতি বাড়বে, তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বল প্রয়োগ করেনি। তবে কিছু মানুষের জন্য নগরবাসীকে আর জিম্মি হতে দেওয়া হবে না। আইনের মধ্য থেকে রাজপথ অবরোধকারীদের বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা হবে। ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের মঙ্গলবারের সংঘর্ষের শেষ দিকে রাজপথ থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

রাজপথ অবরোধ করে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেটিজেনরা। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকেও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় অনেককে। সামসুল আলম নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক চাকরিজীবী ফেসবুকে লেখেন, মন চাইলেই রাস্তা অবরোধ করে নেমে যাচ্ছে একদল মানুষ। শত শত মানুষকে জিম্মি করে দুর্ভোগ তৈরি করা হচ্ছে রাস্তায়। মানুষের সুবিধা-অসুবিধাও এরা বুঝতে চায় না।

সম্প্রতি রাস্তায় সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার গাড়ি আটকে দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলেন। সড়ক অবরোধকারীরা সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে তর্কে জড়ায়। এসব ভিডিওর কমেন্ট সেকশনে অবরোধকারীদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন নেটিজেনরা।

Advertisement

প্রসঙ্গত, গতকাল ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলার একপর্যায়ে পুলিশ কঠোর হয়। লাঠিপেটা করে। পুলিশের অভিযানের বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভিডিওতে দেখা যায়, রাস্তা ভাঙচুরকারীদের লাঠিচার্জ ও চড়-থাপ্পড় মারছেন পুলিশ সদস্যরা। এসব ভিডিওর কমেন্টে নেটিজেনরা বলেন, আরও আগেই পুলিশের এই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল।