ওয়ার্ল্ড ক্রাইম নিউজ ২৪.কম (টিভি),বিশেষ প্রতিনিধি,বুধবার ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ || ফাল্গুন ৬ ১৪৩১ :
ঢাকার সড়ক, অলি-গলিতে হুটহাট ঝুঁকিপূর্ণ গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে উচ্চশব্দে হর্ন বাজানোর মতো সামাজিক উৎপাতের একটি ঘটনার প্রতিবাদকারী এক দম্পতির করুণ পরিণতির বিষয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রকাশ্যে এমন নৃশংসতার কারণ কী, তা নিয়ে কৌতূহল বাড়ছে মানুষের মনে।
Advertisement
সামাজিক উৎপাত করা এই শ্রেণি কতটা ভয়ংকর, তাদের সন্ত্রাসী চক্র কতটা বেপয়োরা, সেই নমুনাও দেখা যায় উত্তরায় প্রকাশ্যে এই দম্পতিকে রামদা দিয়ে কোপানোর ঘটনায়। একই সঙ্গে উঠে আসছে ‘গ্যাং কালচার’-এর ভয়াবহ চিত্র। সেই সঙ্গে ভিডিওতে দেখা যাওয়া সন্ত্রাসীদের পরিচয় বেরিয়ে আসছে।
ঢাকার উত্তরায় ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টার দিকে ওই দম্পতিকে প্রকাশ্যে কোপায় একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা।
সন্ত্রাসীদের আঘাতে গুরুতর জখম হন উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৯/এ রোডের একটি বাসায় বসবাস করা মো. মেহেবুল হাসান ও তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার ইফতি।
পুলিশ বলছে, উত্তরার ঘটনায় গ্রেপ্তার মো. মোবারক হোসেন, যার বয়স ২৫ বছর এবং ২২ বছর বয়সি রনি রায়কে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার তাদের ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে তোলা হলে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক।
মোবারক ও রনির রিমান্ড চেয়ে করা আবেদনে উত্তরা পশ্চিম থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দ্বীন ইসলাম লিখেছেন, ভিডিওতে রামদা হাতে যে দুজনকে দেখা যাচ্ছে, তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে তাদের নাম জানা গেছে। রামদা নিয়ে মেহেবুল ও ইফতিকে কোপাচ্ছিলেন আরাফাত ও সাইফ নামে দুজন। তারা উত্তরায় বসবাস করেন বলে ধারণা।
অবশ্য কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি রাইজিংবিডি ডটকম। যদিও ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরো তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
উত্তরা পশ্চিম থানা জানিয়েছে, ভিডিওতে যে দুজনের হাতে রামদা দেখা গেছে, তাদের ডেকে আনেন মোবারক ও রনি। হামলায় জড়িত অন্যদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের জন্য মোবারক ও রনিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, মেহবুল হাসান ও ইফতি দম্পতি উত্তরার আমির কমপ্লেক্সে শপিং করে ফিরছিলেন। তারা উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে ১০ নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছালে ইফতিদের মোটরসাইকেলের দুই পাশ দিয়ে অন্য দুটি মোটরসাইকেল জোরে হর্ন বাজিয়ে এলোমেলোভাবে যাচ্ছিল। একটিতে দুজন, অন্যটিতে ছিলেন একজন আরোহী। তাদের একটি মোটরসাইকেল সামনের মোড়ে একটি রিকশায় ধাক্কা দেয়।
অভিযোগ অনুযায়ী, চালকসহ ধাক্কা খাওয়া রিকশায় চার বছর বয়সি শিশু ও তার বাবা-মা ছিলেন। শিশুটির বাবা নেমে মোটরসাইকেলে থাকা তিন ব্যক্তির এ ধরনের বেপরোয়া কাজের প্রতিবাদ করলে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে থাপ্পর মারেন ওই ব্যক্তি। তখন মেহেবুল হাসান এগিয়ে গিয়ে বলেন, “ভাই, সরি বললেই তো হয়ে যায়। এত ঝামেলার করার কী দরকার?”
ইফতির বর্ণনা অনুযায়ী, এরপর ঘটনাস্থল থেকে রিকশার আরোহীরা চলে যান। তবে তখনো মেহেবুল হাসানের সঙ্গে তর্ক চলছিল ওই দুই মোটরসাইকেলের তিনজনের। একপর্যায়ে তারা মেহেবুলকে ধমকাতে থাকেন। তিনজন মিলে মেহবুলকে মারপিট শুরু করেন। তখন ইফতি তাদের বাধা দেন।
তিন ব্যক্তির মধ্যে একজন বলে ওঠেন, “তুই আমাদের চিনিস, আমরা কে?”এরপর মোবাইল করে লোকজন ডেকে আনেন ওই ব্যক্তি। তখন সেখানে কয়েকজন লোক জড়ো হয়ে যায়। তারা মোটরসাইকেলের ওই তিনজনকে থামানোর চেষ্টা করেন। এই ফাঁকে ১০ মিনিটের মধ্যে চার-পাঁচজন ব্যক্তি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে মেহেবুল ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা চালায়। এই দম্পতিকে তারা সেখানে কোপাতে থাকে।
Advertisement
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১৩ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, সাদা ও জলপাই রঙের শার্ট পরা দুই যুবক একজন পুরুষ ও তার সঙ্গে থাকা এক নারীকে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছেন। এ সময় জীবন বাঁচাতে ওই নারীকে হাত জোড় করে সন্ত্রাসীদের থামতে অনুরোধ করতে দেখা যায়। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন অস্ত্রধারীদের ধাওয়া দিয়ে ধরে ফেলে এবং পিটুনি দেয়।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে মঙ্গলবার বিকেলে কথা হয় ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার প্রধান উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের সঙ্গে।
রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেন, “যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তাতে যাদের দেখা যাচ্ছে, ছবি ধরে ধরে তাদেরও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।”
“এ জন্য পুলিশের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছি।”
১৩ সেকেন্ডে ভিডিওর শুরুতে নারী-পুরুষের চিৎকার, চেঁচামেচি শোনা যায়। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ভিডিওটি জুম করা হয়। তখন দেখা যায়, সড়কের মাথায় একটি বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাতের পাশাপাশি থাকা এক নারীকে রামদা দিয়ে জোরে আঘাত করছে এক যুবক। নারীর পাশে থাকা পুরুষকে কোপাচ্ছে আরেক যুবক। এরপর নারী-পুরুষ দুদিকে সরে যান। একপর্যায়ে ওই পুরুষ একটি রিকশার পাশে গিয়ে আশ্রয় নেন।
ভিডিওর এই নারী-পুরুষের নাম-পরিচয় এরই মধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে। ভিডিওর নারী হলেন ইফতি ও পুরুষ হলেন মেহেবুল।
ভিডিওর শেষ দিকে দেখা যায়, ইফতি তার স্বামীকে বাঁচাতে রামদা হাতে এক যুবকের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে যান। তখনই একজনকে বলতে শোনা যায়, “দাও দিয়ে কোপাইতেছে, এটা কোন কথা।” এরপর অস্ত্রধারীরা চলে যাওয়া শুরু করে। তখন লোকজন ধাওয়া দিয়ে দুজনকে ধরে ফেলে। তাদের গণপিটুনি দেয় জনতা।
উত্তরা পশ্চিম থানার তদন্ত কর্মকর্তা দ্বীন ইসলাম বলেছেন, গণপিটুনিতে আহত মোবারক ও রনিকে উত্তরার কুয়েত বাংলাদেশি মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। মোবারকের মাথায় সেলাই দেওয়া লেগেছে। তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রিমান্ডের আবেদন অনুযায়ী, মোবারক ও রনি টঙ্গীতে বসবাস করেন। তাদের আধিপত্যের এলাকা উত্তরা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই গ্যাং কালচার এখন যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ঢাকাসহ সারা দেশে শহর-গ্রামে এখন গ্যাং কালচার দেখা যাচ্ছে। বিপৎগামী কিশোর-তরুণ এই কালচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। যাদের বেশিরভাগ রঙিন জীবনের নেশায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী ‘ভাই গ্যাং’ এর খপ্পরে পড়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
পুরো বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, ডেমরাসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের দৌরাত্ম্য বেশি।
Advertisement
১৮ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরে ‘কব্জিকাটা আনোয়ার’ নামে সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশের দেওয়ার তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ারের নেতৃত্বে মোহাম্মদপুর সক্রিয় একটি কিশোর গ্যাং। তারা নানা অপরাধে জড়িত।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, নাসরিন আক্তার ইফতি ও তার স্বামী মেহেবুল হাসানের সামনে রামদা নিয়ে কোপাতে উদ্ধত দুই যুবক। তাদের সামনে হাত জোড় করে স্বামীকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন ইফতি। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া