হাসনাত-তাহমিদ ছাড়াও ‘সন্দেহে’ আরও যারা

SHARE

hasanat-tauhidঢাকা : গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার পর উদ্ধারকৃতদের মধ্যে চারজনকে সন্দেহে রেখেছে তদন্তকারীরা। তারা হলেন— জাকিরুল ইসলাম (২২), নাজরুল সারেন (৫০), তাহমিদ হাসিব খান (২২) ও আবুল হাসনাত রেজাউল করিম (৪৭)।

তাদের মধ্যে জাকিরুল ও সারেনকে আহত অবস্থায় আটক করা হয়েছে। তারা দুজনই এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন। তাহমিদ ও হাসনাত অক্ষত উদ্ধার হলেও হামলার সময় ও পরে তাদের ভুমিকা নিয়ে সন্দেহের তৈরি হয়েছে।

তাদের এখনো আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে দাবি করছেন স্বজনরা। তবে পুলিশ বলছে, দু’জনকেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গুলশান হামলার পর জীবিত অবস্থায় উদ্ধারকৃতদের মধ্যে জাকিরুলকে প্রধান সন্দেহে রাখা হচ্ছে। নিহত দুই হামলাকারীর বাড়ির কাছেই, বগুড়ায় তার বাড়ি। জাকিরুল ঘটনার মাত্র এক মাস আগে ও’কিচেন রেস্টুরেন্টে চাকরি নেয়। গুলি ও বোমার আঘাতে আহত জাকিরুলের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে।

২ জুলাই অভিযান শেষে উদ্ধার তৎপরতা চলার সময় সিএনজি অটোরিকশায় করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন আহত সারেন। নতুনবাজার পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশির সময় আহত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়।

পুলিশ সূত্রমতে, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত ঘটনার রাতে জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে যান। কানাডায় লেখাপড়া করা তরুণ তাহমিদকে অভিযানের সময় জিম্মিদের পেছনে সন্দেহজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গুলশান হামলার ঘটনায় ও’কিচেন ও হলি আর্টিসানের দুই পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ও জাকির হোসেন শাওনকেও সন্দেহ করা হচ্ছে। তবে তারা দুজনই ইতোমধ্যে মারা গেছেন।

পাঁচ বিদেশিসহ উদ্ধারকৃত অপর ৩০ জনকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চারজনের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি হামলার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আহত দুজন সুস্থ হলে তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ও গুলশান বিভাগের দুই কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার পর থেকেই জাকিরুলকে ব্যাপকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় তাকে দ্রুত চিকিৎসা দেয়া হয়। সারেন হাসপাতালে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। হাসনাত ও তাহমিদের বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ড রহস্যজনক। চারজনের ব্যাপারেই তদন্ত চলছে।

পুলিশ জানায়, জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে মোট ৩৫ জন জীবিত বের হয়েছে। তাদের মধ্যে ছিল সন্দেহভাজন কর্মী শাওন। স্লিন্টারের আঘাতে আহত শাওন গত শুক্রবার ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। আরেক সন্দেহভাজন কর্মী সাইফুল অভিযানের সময়ই নিহত হয়। জঙ্গি হামলার সময় এ দুই কর্মীর গতিবিধি সন্দেহজনক ছিল বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। কেউ কেউ ধারণা করছেন, জঙ্গিরা জিম্মির পর তাদের দলে ভেড়ায়।

এদিকে আহত অপর দুজন ছাড়া অক্ষত যে ৩২ জনকে উদ্ধার করা হয় তাদের মধ্যে পাঁচজন বিদেশি। তারা হলেন— শ্রীলঙ্কান পেপেথা শায়ামা বিজেসেকেরা ও হারিকেশা বিজেসেকেরা; আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত ইতালিয়ান ডিয়াগো রোসিনি; ইতালিয়ান জিয়ান জালেহো বোসেনি এবং জাপানি নাগরিক ওয়াতানাবে তামোকে।

বাংলাদেশিরা হলেন— মিরাজ হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, আকাশ খান, শিশির সরকার, দ্বীন ইসলাম রাকিব,  সুহিন , শাহরিয়ার আহমেদ, কেএম রেজাউল ইসলাম, আরিফ মাহমুদ শাওন, সবুজ হোসেন, রেন্টু কীর্তুনিয়া, নিয়ামুল মুন্সী, লিটন ইসলাম, সমীর বাড়ই, ইমাম হোসেন সবুজ, আবদুল মোমিন, শিশির বৈরাগী,  বাচ্চু, শাহীন, শেফা করিম, রায়হান করিম, সত্য প্রকাশ,  ফাইরোজ মাহিন, তাহানা তাসমিয়া, তাহমিদ হাসিব খান, শারমিনা করিম, আবুল হাসনাত রেজাউল করিম। হাসনাত ও তাহমিদকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছে পুলিশ। তবে উদ্ধারকৃতদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

সিটিটিসি ইউনটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে এই ঘটনায় আহত একজন ছাড়া আর কেউ এখন আটক নেই। সুস্থ হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

জাকিরুলের বাড়িও বগুড়ায়
গুলশান হামলায় অংশ নিয়ে নিহত হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে দুজনের বাড়ি বগুড়ায়। খায়রুল ইসলাম পয়েল বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার চোপনিগর ইউনিয়নের বৃ-কুষ্টিয়া গ্রামের দিনমজুর আবু হোসেনের ছেলে। শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলের বাড়ি বগুড়ার ধুনট থানার কৈয়াগারী গ্রামে। তার বাবার নাম বদিউজ্জামান।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাকিরুরের বাড়িও বগুড়ায়, নিহতদের বাড়ির কাছাকাছি এলাকায়। ঘটনার মাত্র এক মাস আগে জাকিরুল হলি আর্টিসানে কাজে যোগ দেয়। হামলার পর অভিযানের সময় তার জিম্মিদের সঙ্গেই থাকার কথা ছিল। তিনি তেমনটি ছিলেন না। থাকলে তিনি আহত হতেন। ফলে আহত হওয়া এবং ঘটনায় ভূমিকার কারণে জাকিরুলকে প্রধান সন্দেহে রেখেছে পুলিশ।

গত ৫ জুলাই তাকে ঢামেক হাসপাতালে নেয়া হয়। এর আগে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালেও আইসিইউতে ছিল সে।

সন্দেহজনক সারেন
২ জুলাই সকালে অভিযান শেষে উদ্ধার তৎপরতা চলার সময় সিএনজি অটোরিকশায় করে পালিয়ে যাচ্ছিলেন আহত নাজরুল সারেন। বারিধারার নতুনবাজার এলাকায় পুলিশ চেকপোস্টে তল্লাশির সময় আহত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আহত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। তার শরীরে স্লিন্টারের জখম আছে। ঢামেক হাসপাতালের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সারেন।

তাহমিদের বাবা হাসপাতালে

রাজধানীর বারিধারা এলাকার অভিজাত পরিবারের সন্তান তাহমিদ কানাডায় লেখাপড়া করেন। পুলিশ সূত্র দাবি করছে, ঘটনার সময় তাহমিদের হলি আর্টিসানে যাওয়া এবং সেখানে অবস্থান করা নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। অভিযানের সময় তিনি জিম্মিদের পেছনে সন্দেহজনকভাবে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। এদিকে ১২ দিনেও তাহমিদকে না পেয়ে উৎকণ্ঠায় আছেন তার স্বজনরা। সোমবার রাতে তার বাবা শাহরিয়ার খানের মোবাইল ফোনে কল করলে এক আত্মীয় তা রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘মামার স্ট্রোক হয়েছে। তিনি অ্যাপোলো হাসপাতালে আছেন।’

হাসনাতের পরিবারের দাবি
স্ত্রী শারমিন করিম, মেয়ে সেফা করিম ও ছেলে রায়হান করিমকে নিয়ে ওকিচেন রেস্টুরেন্টে যান হাসনাত। জঙ্গি হামলার পর প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে তিনি জঙ্গিদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন— এমন চিত্র দেখা গেছে। এতে সন্দেহ হলে হাসনাতকে  জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

হাসনাত দাবি করেন, জঙ্গিরা তাকে ও তার স্ত্রীকে সমীহ করেছিল। জীবন বাঁচাতে তারাও জঙ্গিদের কথামত চলেন। এরপর পুলিশ হাসনাতের ল্যাপটপ জব্দ করে। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদলয় থেকে বহিষ্কৃত এই শিক্ষকের বাবা এম রেজাউর রহমান বলেন, মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে রেস্তোরাঁয় পরিবার নিয়ে খেতে যায় হাসনাত। গত কয়েকদিন ধরে পুলিশ তাকে আটক রাখলেও পরিবারের কাছে তা স্বীকার করছে না।